‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ যবিপ্রবির ক্যাফেটেরিয়ায় একযুগেও গড়ে উঠেনি স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ

0

যবিপ্রবি সংবাদদাতা ॥ প্রতিষ্ঠার একযুগ পেরিয়ে গেলেও স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়ার পরিবেশ গড়ে উঠেনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) এর কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ায়। মানসম্পন্ন খাবারের অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি, নিরাপদ খাবার পানি ও স্যানিটেশনের অভাবসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত যবিপ্রবির একমাত্র ক্যাফেটেরিয়া। শিক্ষার্থীরা একরকম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই খাচ্ছে ক্যাফেটেরিয়ার অস্বাস্থ্যকর খাবার। এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে একাধিকবার অভিযোগসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও মেলেনি সমাধান।
যবিপ্রবি ক্যাফেটেরিয়ায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে কোন ধরণের সুরক্ষা ছাড়াই রান্না করছেন ক্যাফেটেরিয়ায় কর্মীরা। রান্নাঘরের কোন খাবারই ঢাকা অবস্থায় নেই, পাশাপাশি খাবার ও ময়দার খামিরের ওপর ভনভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে মাছি। রান্নাঘরের বেসিন একই পানিতে ধোঁয়া হচ্ছে তরকারি ও থালাবাসন। অন্যদিকে খাবার পানির ফিল্টারে ময়লা জমে কালো রং ধারণ করেছে। নেই হাত ধোয়ার কোন জায়গা, টয়লেটের দুর্গন্ধে ওয়াশরুমের আশেপাশের যাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ক্যাফেটেরিয়ায় নেই কোন নির্ধারিত মূল্য তালিকা, নেই পর্যাপ্ত টেবিল-চেয়ার, হাতেগোনা কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা ছাড়া সবগুলোই নষ্ট।
এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের শিক্ষার্থী তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ক্যাফেটেরিয়াকে। যেখানে মুক্ত আলোচনা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্লাসরুমের বাইরেও নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে। একাডেমিক পড়াশোনায় ‘গ্রুপ স্ট্যাডি’ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একরকম অবধারিত বলা চলে, ক্যাফেটেরিয়া সেই ‘গ্রুপ স্ট্যাডি’র উপযুক্ত স্থানগুলোর অন্যতম। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে রাতের খাবার এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ভালো একটি উৎস হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়া। বিভিন্ন সংগঠনের সাপ্তাহিক বা মাসিক কার্যক্রম সম্পাদনের বহুল পরিচিত স্থান হিসেবে ব্যবহৃতও হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটিয়া। খুব বেশি শিক্ষার্থীর আনাগোনা হয় না এখানে। কেনই বা হবে? নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা যদি বাদও দেই, সকাল-দুপুর-রাতের খাবারের কথাও যদি বাদ দেই, তারপরও গ্রুপ স্ট্যাডি, আড্ডা এবং মুক্ত আলোচনার পরিবেশ আমাদের ক্যাফেটেরিয়ায় নেই। যারা এই ক্যাফেটেরিয়ার টয়লেটে গেছেন তারা খুব ভালো করে বুঝবেন। অথচ এখানে পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে এর বিপরীত চিত্রটাই কাঙ্খিত ছিল। ‘বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’ শ্লোকটার একটা উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে আমাদের ক্যাফেটেরিয়া। শিক্ষার্থীরাও এ নিয়ে খুব একটা কথা বলেন না! তাই অবস্থার উন্নতিও হয় না। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি শিক্ষার্থীদের মুক্ত আলোচনা, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে বঞ্চিত করার আধুনিক পন্থা?’
ফার্মেসী বিভাগের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের দাম ও মানের কথা চিন্তা করলে আমার কাছে ক্যাম্পাসের বাইরের হোটেলে খাবারের মান ও দাম দুটোই ভালো। এখানে খাবারের মূল্য তালিকা যেটা দেওয়া সেগুলো পাওয়া যায় না। এছাড়া বাইরে থেকে যদি একজন গেস্ট আসে, ফ্রেশ হওয়ার জন্য তাকে ক্যাফেটেরিয়ার ওয়াশরুমে যেতে দেওয়া যায় না। এত বাজে যে, কেউ গেলে বমি করে ফেলবে। এসব নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ কখনো মাথা ঘামাই না, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও কোনো নজর দেয় না। আমরা চাই, খাবারের মান স্বাস্থ্যসম্মত হোক পাশাপাশি দামটাও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকুক এবং ওয়াশরুমের পরিবেশটা ভালো হোক।’
গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ বলেন, ‘ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের দাম অনুযায়ী মানের অবস্থা ভালো না। আমার অনেক বড়ভাই, সহপাঠীরা দামের কারণে ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে পারেন না। প্রতিদিন গড়ে অন্তত দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এখানে আসে কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম সংখ্যক আবাসন রয়েছে এখানে। শিক্ষার্থীদের একটা গ্রুপকে ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় যতক্ষণ না আরেকটা গ্রুপ স্থান ত্যাগ করে। এর সাথে রয়েছে নষ্ট বৈদ্যুতিক পাখার বিশাল সমস্যা, হাতেগোনা কয়েকটি বৈদ্যুতিক পাখা ছাড়া সবগুলোই নষ্ট। শিক্ষার্থীরা চায় বন্ধুদের সাথে একটা ভাল সময় যেন এখানে কাটাতে পারে কিন্তু কর্তৃপক্ষের বাজে ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ দ্রুত ক্যাফেটেরিয়ার সব সমস্যার সমাধান করে একটা শিক্ষার্থী বান্ধব ক্যাফেটেরিয়া আমাদের ফিরিয়ে দিবেন।’
এ বিষয়ে পুষ্টি ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. শিরিন নিগার বলেন, ‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে ক্যাফেটেরিয়ার খাবার তৈরি, পরিবেশন ও পরিবেশের যে ছবি ও ভিডিও দেখেছি সেসব খাবার খেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রোগ যেমন পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, পেটে গ্যাস, মাথা ব্যথা, ফুড পয়জনিং, কিডনি অকেজো ও লিভারের জটিলতা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার তৈরি, খবার উন্মুক্ত রাখা ও মাছি বসার কারণে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু যেমন বেসিলাস, ক্লোস্ট্রিডিয়াম বোটুলিনম, সাল্মোনেলা, ইকোলাই, লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিন, শিগেলা, নরোভাইরাস ও প্যারাসাইট বা পরজীবীসহ প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস খাবারে বংশবিস্তার করে। এমনকি এটি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে ব্যহত করতে পারে।’
এ বিষয়ে ম্যানেজার শাহিদুর ইসলাম বলেন, ‘টয়লেট সংস্কার ও পরিষ্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে মহাজন চিঠি দিয়েছে। চাইনিজ খাবারের মূল্য তালিকা থাকলেও সাধারণ খাবারের তালিকা না থাকাটা দুঃখজনক। সাধারণ খাবারের মূল্যতালিকা সংযোজন ও পানির ফিল্টার লাগানোর জন্য মহাজনকে বলেছি। আর খাবার সবসময় ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, তবুও আমরা চেষ্টা করছি খাবার ঢেকে রাখার ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার।’
এ বিষয়ে যবিপ্রবি’র উপাচার্য জানান, ‘শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কখনো আমার কাছে অভিযোগ করেনি তবুও আমি বিভিন্ন সময়ে নিজে ক্যাফেটেরিয়া পরিদর্শন করে দেখেছি সেখানের অবস্থা খুবই খারাপ। এ বিষয়ে আমি দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি – খুব শীঘ্রই ক্যাফেটেরিয়ার দায়িত্বে যিনি রয়েছে তাকে সরানো হবে। ক্যাফেটেরিয়াকে খুব দ্রুত আধুনিকায়ন করা হবে এবং সেখানে যেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটি সুন্দর পরিবেশ পায় সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’