মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস করে শত বিঘা জমির মালিক সালাম!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সিআইডির হাতে গ্রেফতারের পর স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যান আবদুস সালাম
ছোটবেলা থেকে জমির প্রতি দুর্বলতা ছিল আবদুস সালামের। কিন্ত স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর মেশিনম্যানের মতো ছোট চাকরি করে জমি কেনা কঠিন। তাই এজন্য যেকোনও অসৎ কাজ করতে প্রস্তুত ছিল সে। সেই লক্ষ্য পূরণে ২০০৬ সালে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার কাজ চলাকালে প্রশ্ন বের করে আনে মেশিনম্যান আবদুস সালাম। প্রতি বছর মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে অসদুপায়ে আয় করে কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা দিয়ে গড়ে অঢেল সম্পত্তি।
সিআইডি বলছে, মেশিনম্যান আবদুস সালামের ঢাকা, সাভার ও মানিকগঞ্জে বিপুল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি আছে। তাকে গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা প্রায় ১০০ বিঘা জমির বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। তার আরও জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে কাগজ পাঠানো হয়েছে। সিআইডির সিনিয়র এএসপি (মিডিয়া) জিসানুল হক জিসান বলেন, ‘আমরা সালামকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পেয়েছি। জিজ্ঞাসাবাদে তার জমি ও অন্য সম্পত্তি সম্পর্কে আরও জানতে পারবো।’ সোমবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের এই মাস্টারমাইন্ড আব্দুস সালামকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার বিভাগ। শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতোই অপরাধ না, ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানায় দায়ের করা হত্যা মামলার অভিযুক্ত পলাতক আসামি স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর এই মেশিনম্যান।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ২০০৬ সালে প্রশ্ন ফাঁসের পর বিষয়টি জানাজানি হয়েছিল। সে সময় প্রথম দফায় ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করে রাখা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছিল। প্রশ্ন ফাঁসে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় সালামকে তৎকালীন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. সেফাত উল্লাহ প্রশ্ন ছাপার মেশিন থেকে সরিয়ে দেন। এ কারণে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সালাম প্রশ্ন ফাঁস করতে পারেনি। কিন্তু ২০০৯ সালে এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর তদবিরে আবারও ছাপাখানার মেশিনম্যান পদে ফিরে আসে সে। এরপর থেকে প্রতি বছরই মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস করতো সে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর প্রতিবছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়রের অধীনে থাকা একটি প্রেস নির্বাচন করতো। সেখানে অধিদফতরের প্রশ্নপত্র তৈরি কমিটির নির্দিষ্ট লোকজন ছাড়া অন্যদের যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল। তবে ছাপা মেশিন চালানোর জন্য একজন মেশিন ম্যান ও একজন সহযোগী নেওয়া হতো। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছরই সালাম মেশিনম্যান হিসেবে কাজ করেছে। এই সুযোগে সালাম প্রশ্ন ফাঁস করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে তার খালাতো ভাই জসিমের কাছে দিত।
সিআইডি বলছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতো আবদুস সালাম। তার খালাতো ভাই জসিমউদ্দিন তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতো। জসিমের কাছ থেকে ৮০ শিক্ষার্থীর চেক জব্দ করা হয়েছে। মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই ৮০ জন শিক্ষার্থীর তথ্য খোঁজা হচ্ছে। তারা কে কোথায় ভর্তি হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম-ঠিকানা পাওয়া গেছে। শোভন নামে একজন খুলনা মেডিক্যাল কলেজে, মাহমুদা পারভীন ঋতু নামে একজন বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে, রিয়াদ নামে একজন সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ও মুবিন নামে একজন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। এর বাইরে ঢাকায় ডেন্টালসহ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ধরতে অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু করোনার পরিস্থিতির জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। এই পর্যায়ে গ্রামের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহের কাজ চলছে। প্রয়োজনে সেখানে অভিযান চালানো হবে।’ মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার পুলিশের অতিরিক্ত বিশেষ সুপার কামরুল আহসান জানান, প্রশ্নপত্র জালিয়াতি চক্রের সদস্য জসিম, পারভেজ খান, জাকির হোসেন ও আব্দুস সালামের মাধ্যমে জানা যায়, ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অসংখ্য শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে টাকা উপার্জন এক প্রকার পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে আব্দুল সালামের। পরিবারের অনেকেই গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সালামের মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, ভায়রা ভাই, চাচাতো ভাই সবাই প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সক্রিয় সদস্য। সালামের খালাতো ভাই জসিমেরই ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। সেখানে গচ্ছিত আছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। জসিমের স্ত্রী শিল্পীরও ১৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। তার ব্যাংকেও ১০ কোটি টাকা আছে।’ সিআইডির এই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তাদের সম্পদের উৎস খুঁজেছি। সম্পত্তির অনুসন্ধান শেষে এই চক্রের সবার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁস করে আয় করা অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সরকারি হেফাজতে নেওয়ার জন্যও আবেদন করা হবে।’