বিসিবির ‘কালো বিড়াল’ বের করতে চায় দুদক

0

স্পোর্টস ডেস্ক ॥ ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে রয়েছে তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের বিষয়ে, বিপিএলের টিকিট বিক্রির টাকায় অনিয়ম ও মুজিব শতবর্ষ আয়োজনেও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। সেটি আমরা এখানে এসে দেখেছি। এই জিনিসগুলো আমরা এখন যাচাই-বাছাই করব।’

নাজমুল হাসান পাপনের গা ঢাকা দেওয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দায়িত্ব নেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। শুরুতেই জানিয়েছিলেন, বিসিবিতে দুর্নীতি হয়েছে, এটি তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না। এমনকি ফারুক নিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন, অন্যান্য বিভাগে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার কিছু তো বিসিবিতেও হয়েছে। এটা সবাই জানেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

গেল বছরের আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও বলেছিলেন, ক্রীড়াঙ্গনে হওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশেষে দুর্নীতির কালো বিড়াল বের করার দায়িত্ব নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল মিরপুরে বিসিবি প্রাঙ্গণে এক ঝটিকা অভিযানে হাজির হয়েছিলেন তিন কর্মকর্তা। পাপনের আমলে বিপিএলের টিকিট বিক্রিতে দুর্নীতি, তৃতীয় বিভাগ বাছাই ক্রিকেটে অনিয়ম ও মুজিব শতবর্ষ আয়োজনে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এমন অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) বিসিবির সিইও নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সুজন বলেছেন, ‘দুদক থেকে আসা কর্মকর্তারা কিছু বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়েছেন। আমরা আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে বলেছি তাদের সহযোগিতা করার জন্য।’ তবে কোন বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করছে দুদক, সেটি সুজন বলেননি। বিষয়টি খোলাসা করেছেন দুদকের কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান। অভিযান পরিচালনা শেষে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ ছিল। তার মধ্যে রয়েছে তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের বিষয়ে, বিপিএলের টিকিট বিক্রির টাকায় অনিয়ম ও মুজিব শতবর্ষ আয়োজনেও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। সেটি আমরা এখানে এসে দেখেছি। এই জিনিসগুলো আমরা এখন যাচাই-বাছাই করব।’

তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ে দুর্নীতি
২০১৪-১৫ মৌসুমে তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগে খেলার ফি ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়। এরপর টুর্নামেন্টটিতে দলের সংখ্যা কমতে থাকে। গেল কয়েক বছরে পাঁচটির বেশি দল এই প্রতিযোগিতায় দেখা যায়নি। কখনো কখনো সেটি দুই-তিন দলেও নেমে এসেছে। তাতে টুর্নামেন্টটি প্রতিযোগিতাহীন হয়ে পড়েছিল। ফারুক আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর এবার আবেদন ফি কমিয়ে করা হয়েছে ১ লাখ টাকা। সঙ্গে শিথিল করা হয়েছে কিছু শর্ত। তাতে এবারের বাছাই লিগের জন্য ৬০টি দল আগ্রহ প্রকাশ করে।

এই বিষয়ে দুদকের কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ‘তৃতীয় বিভাগ বাছাই লিগে এবার ৬০টি দল অংশ নেওয়ার আবেদন করেছে। আগে দুই থেকে তিন বা সর্বোচ্চ চার দলের লিগ হতো। এখানে হয়তো কোনো কারণ আছে। আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি, এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা বোর্ডের কোনো প্রভাব ছিল কিনা দেখার জন্য। এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে, আগে হয়তো অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ছিলনা, কোনো চাপ ছিল, যে কারণে দলগুলো আসত না। আমরা বিস্তারিত যাচাই-বাছাই করে বুঝতে পারব, এখানে কী অসংগতি ছিল।’

বিপিএলের টিকিট বিক্রির টাকায় নয়-ছয়
একাদশ বিপিএল শেষে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেছিলেন, ‘এবার টিকিট বিক্রি থেকে সব মিলিয়ে সোয়া ১৩ কোটি টাকা আয় করেছে বিসিবি। পুরো বিপিএলে ১২ কোটি ২৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। এর সঙ্গে টিকিট বিক্রি স্বত্ব থেকে পাওয়া ১ কোটি টাকাও যোগ হবে।’ তিনি সে সময়ে জানিয়েছিলেন, ‘বিপিএলের আগের ১০ আসর থেকে বিসিবি সর্বমোট ১৫ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছিল। সে বিবেচনায় আমরা এক বছরে তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।’ এই বিষয়টি আমলে নিয়েছে দুদক। ফারুকের বোর্ড এক বছরে ১৩ কোটি টাকার বেশি আয় করলে পাপনের আমলের ৮ আসরে কেন এই সংখ্যা-মাত্র ১৫ কোটি, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই বিষয়ে দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে।

মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ‘আগে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ নিয়ে টিকিটের ব্যাপারে চুক্তি করা হতো। তারা টিকিট বিক্রি করে বিসিবিকে একটা অংশ দিত। গত তিন থেকে চার আসরে বিসিবি নিজ থেকে টিকিট বিক্রি করছে। যার প্রেক্ষিতে একাদশ আসরে আমরা দেখেছি, ১৩ কোটি টাকা আয় হয়েছে। আট বছরে যেখানে ১৫ কোটি, এক বছরেই ১৩ কোটি। রেকর্ডপত্র আমরা পেয়েছি। বিস্তারিত যাচাই করলেই বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে কী অসংগতি হয়েছে।’

মুজিব শতবর্ষ আয়োজনে অর্থ আত্মসাৎ
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২০২০-২১ সালে মুজিব শতবর্ষ পালনে দেশ জুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। বিসিবিও অংশ নিয়েছিল সেখানে। জাঁকজমকপূর্ণ কনসার্টসহ বঙ্গবন্ধু বিপিএল করেছিল দেশের ক্রিকেট বোর্ড। সেই আয়োজনেও অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে দুদক।

গতকাল দুদকের সহকারী পরিচালক আল আমিন বলেছেন, ‘কনসার্টসহ যে আয়োজন হয়েছিল, সেখানে সব মিলিয়ে ২৫ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আমরা এই অভিযোগ পেয়েছি। তবে আসলে খরচ হয়েছে ৭ কোটি টাকার মতো। এখানে প্রায় ১৯ কোটি টাকা সরানো হয়েছে বা কিছু হয়েছে। এরকম অভিযোগ আমরা পেয়েছি। বিসিবির অর্থ বিভাগের কাছ থেকে কাগজপত্র চেয়েছি। কিছু কাগজ পর্যালোচনায় আমরা বুঝতে পেরেছি, এখানে প্রায় ১৯ কোটি টাকার হিসেবে অস্বাভাবিকতা আছে। এছাড়া টিকিট বিক্রির ২ কোটি টাকাও এখানে দেখানো হয়নি। তাই এখানে টাকা আত্মসাতের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। সব কাগজপত্র হাতে পেলে সুনির্দিষ্ট করে আমরা বলতে পারব।’

বিসিবিতে অভিযান পরিচালনা নিয়ে দুদক কর্তারা জানিয়েছেন, তারা যে তথ্যগুলো পেয়েছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে এনফোর্সমেন্ট ইউনিটে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সেই অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।