আজ খুশির ঈদ

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ ॥ ‘সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মুরতি লভিয়াছে হর্ষে, আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভার জাগিয়াছে, রাখিতে হবে সারা বর্ষে/ এ ঈদ হোক আজ সফল ধন্য, নিখিল মানবের মিলনের জন্য;/ শুভ যা জেগে থাক, অশুভ ঘুচে যাক, খোদার শুভাশীষ পর্শে’-এই শিক্ষা নিয়ে বছর ঘুরে ফিরে এসেছে ঈদুল ফিতর আবার দুয়ারে। ঈদ মোবারক।

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর দেশের মুসলমানরা বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ঈদের জামাতের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সারাদেশে ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‍্যাব ও পুলিশসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি বজায় রাখবে। । সাদা পোশাকে র‍্যাব ও পুলিশ সদস্যরা তৎপর থাকবে। প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। ইতোমধ্যে সেখানে ঈদের জামাতের

সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জাতি এমন এক মুহূর্তে এ বছর ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন দেশ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নতুন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে এবং শাস্তিতে-স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে।

এই ঈদে জাতি আরও একটি খুশির খবর নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে যাচ্ছে। আর এটি হলো- রমজান মাস ও ঈদকে কেন্দ্র করে চলতি মাসে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। ফলে মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।

আসল কথা হচ্ছে-মানুষের মাঝে আল্লাহর ভয় তথা তাক্বওয়ার গুণাবলী সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের মাঝে আগমন করছে ঈদুল ফিতর। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও আনন্দের বার্তা সলমানদের। নিয়ে আসে। ঈদুল ফিতর ধনী-গরীব সব শ্রেণির মুসলমানদের ানদের মধ্যে নিবিড় ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে। ঈদের এই দিনে আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষে মানুষে দয়া, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্য, ঐক্য ও ভালোবাসার এক মহা সেতুবন্ধন তৈরি করি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠনে তৎপর হই এবং সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসি ও একে অপরের সুখানন্দ এবং দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিই। এই হোক ঈদের মূলমন্ত্রণা।

রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে দেশবাসী ছাড়াও তারা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।

বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো ঈদের দিন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা, নিউজ পোর্টালগুলো বিশেষ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করেছে।

ঈদের দিন দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশু সদন, ছোটমনি নিবাস, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র, ভবঘুরে কল্যাণ কেন্দ্র ও দুস্থ কল্যাণ কেন্দ্রসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।

বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় কর্মসূচি ও নিজ নিজ কর্মসূচির আলোকে ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন।
এ ছাড়া বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহে যথাযথ মর্যাদায় সরকারি কর্মসূচির আলোকে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে।

এবার ঈদুল ফিতরে সাপ্তাহিক ছুটিসহ ৯ দিনের ছুটি পেয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত বৃহস্পতিবার থেকে ছুটি শুরু হয়েছে।

ঈদ উপলক্ষে মুসলমানদের নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীসহ সারাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ঈদ মিছিল ফিরছে রাজধানীতে
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) উদ্যোগে এবার পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠে ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

সুলতানি মোঘল আমলে পুরোনো ঢাকায় একসময় ঈদ মিছিল হতো। সেই পুরোনো ঈদ মিছিল আমরা আবার ফিরিয়ে আনতে চায় ডিএনসিসি।

সাধারণত ঈদের জামাত শেষে ঢাকায় সবাই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, বাসায় থেকে ঈদের দিন কাটিয়ে দেয়। তাই এবার সবাইকে ঈদের উৎসবে যুক্ত করতে ডিএনসিসি এ উদ্যোগ নিয়েছে। এই ঈদ আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করবে শিল্পী, সংস্কৃতি কর্মী, নারী-পুরুষ, শিশু, সকল ধর্মের, বর্ণের মানুষ।

ঈদের জামাত শেষে সকাল ৯টায় পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠ থেকে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ আনন্দ মিছিল শুরু হবে। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে দিয়ে আগারগাঁও প্রধান সড়ক হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হবে এই আনন্দ মিছিল।

বর্ণাঢ্য এই আনন্দ মিছিলে ব্যান্ড পার্টি, ঘোড়ার গাড়ি, ঢোল, বাজনাসহ নানা আয়োজন থাকবে। পাশাপাশি এই আনন্দ মিছিলে ঈদ মোবারক লেখা ফেস্টুন প্ল্যাকার্ড থাকবে। ৫ আগস্টে সবাই যেমন বিভিন্ন লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিজয় মিছিল করেছেন, তেমনিভাবে যার যার নিজের ম্যাসেজটি নিয়ে আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করা যাবে।

একইভাবে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঈদ র‍্যালি বের করা হবে। সকাল ৮ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিআ’য় ঈদুল ফিতরের প্রথম জামাতের পর এই র‍্যালি শুরু হবে।

র‍্যালিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান নেতৃত্ব দেবেন। র‍্যালিটি টিএসসি হয়ে স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে গিয়ে শেষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করবেন।

চাঁদ দেখা কমিটির সভা
হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। তবে কোনও অবস্থাতে রমজান মাস ৩০ দিনের বেশী দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়ালের প্রারম্ভগণনা করা হয়। ঈদের আগের রাতটিকে ইসলামী পরিভাষায় লাইলাতুল জায়জা (অর্থ: পুরস্কার রজনী) এবং চলতি ভাষায় চাঁদ রাত বলা হয়। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ঈদ হয়, এই কথা থেকেই চাঁদ রাত কথাটির উদ্ভব। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান।

অপরদিকে ২ রাকাত ঈদের নামাজ ৬ তাকবির সহকারে ময়দান বা বড় মসজিদে পড়া হয়। ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পর ঈদুল ফিতরের নামাজের ওয়াক্ত হয। এই নামায আদায় করা ওয়াজিব। ইমাম কর্তৃক জুমার নামাজের পূর্বে খুৎবা প্রদানের বিধান থাকলেও ঈদের নামাজের খুৎবা নামাজের পরে প্রদান করা বিধেয। ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা মুসল্লীর জন্য ওয়াজিব। সাধারণত ঈদের নামাজের পরে সমবেতভাবে মুনাজাত করা হয় এবং মুসলমানরা একে অন্যের সাথে মুসাফাহা ও কোলাকুলি পূর্বক সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকে। ঈদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো, ঈদ মোবারক।

ঈদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের কাজ। ঈদুল ফিতরের সুন্নতের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ঈদের মাঠে গমন এবং নামাজ-শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পাক-পবিত্র হতে হবে।

বাংলাদেশ সহ অন্যান্য মুসলিম প্রধান দেশে ঈদুল ফিতরই হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব।

বাংলাদেশে ঈদ উপলক্ষে সারা রমজান মাস ধরে সন্ধ্যাবেলা কেনাকাটা চলে। অধিকাংশ পরিবারে ঈদের সময়েই নতুন পোষাক কেনা হয়। ঈদের দিন ঘরে ঘরে সাধ্যমত বিশেষ আহারাদির আয়োজন করা হয। ঈদের দিনে সেমাই বা অন্যান্য মিষ্টি নাস্তা তৈরি করার চল রয়েছে। রাজধানী থেকে ঈদের ছুটিতে প্রচুর লোক নাড়ির টানে নিজেদের বসত ভিটেয় ফিরে আসে। এ কারণে ঈদের সময়ে রেল, সড়ক ও নৌপথে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।