ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আশ্রয়ন প্রকল্প প্রশাসনের গলার কাঁটা!

0

তহীদ মনি॥ ভূমিহীন পুনর্বাসনের নামে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আশ্রয়ন প্রকল্প প্রশাসনের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরাদ্দে অনিয়মের কারণে আশ্রয়নের অনেক ঘর থাকছে তালাবদ্ধ। কেউ কেউ বরাদ্দ পাওয়া ঘর ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। বিক্রিও করেছেন এমন তথ্যও মিলছে। আবার ঘরে টাইলস বসিয়ে এসি লাগিয়ে ‘ধনী ভূমিহীনরা’ দিব্যি বসবাস করছেন। ভূমিহীনরূপী আওয়ামী সমর্থকদের পুনর্বাসনেরও অভিযোগ রয়েছে। তবে বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীন হলে প্রশাসন তাদের দলীয় পরিচয় বিবেচনায় আনতে চাচ্ছেন না। ইতোমধ্যে এসিওয়ালা এক ভূমিহীনের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, পতিত সরকারের আমলে যশোরে ২ হাজার ৫০৬টি পরিবারকে আশ্রয়নের মাধ্যমে সরকারি জমি ও ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। এর মধ্যে আশ্রয়ন-২ প্রকেল্পর আওতায় যশোর জেলায় ২৪১৮ টি ‘ক’ শ্রেণির ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ করে খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে ঘর প্রদান করা হয়। প্রতিটি ঘরের জমি বাদে নির্মাণ খরচ ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। খাস জমিতে ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা একক গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়।

এসব ঘরে সুপরিসরে ২টি কক্ষের সামনে টিনের বারান্দা এবং পেছনে রয়েছে রান্না ঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগের পাশাপাশি পুর্নবাসিতদের জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল। আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর পঞ্চম পর্যায়ের ২য় ধাপে উদ্বোধনযোগ্য গৃহের মধ্যে কেশবপুরে জরাজীর্ণ ব্যারাক প্রতিস্থাপন করে একক গৃহের সংখ্যা ছিল ৮০টি। চৌগাছায় ছিল ৪৪টি। শার্শায় ৫০টি এবং বাঘারপাড়ায় ৬০টি ছিল। মণিরামপুরে ৫ম পর্যায়ে একক গৃহের সংখ্যাছিল ৮৮ টি এবং জরাজীর্ণ ব্যারাক প্রতিস্থাপন করে একক গৃহের সংখ্যা ছিল ১২৮টি ।

এর আগে ২০২৩ সালে ৯ আগস্ট সদর উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ২২ মার্চ বাঘারপাড়া, কেশবপুর ও শার্শা এবং ১ নভেম্বর অভয়নগর, ঝিকরগাছা ও চৌগাছা উপজেলাকে ভূমি ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করা হয়। জেলায় সব মিলিয়ে বরাদ্দপ্রাপ্ত মোট ঘর সংখ্যা ছিল ২৫০৬টি। ২০২৪ সালের জুন মাসে পুরো যশোরকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোরকে ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করে আওয়ামী সরকার।

সাধারণত ভূমিহীন, গৃহহীন লোকরা এই প্রকল্পের সুবিধার আওতায় থাকার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার দলীয় প্রভাবশালী ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দলীয় লোকদেরকে এই ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বরাদ্দ দেয়া এ ঘরগুলোর বরাদ্দ দেয়া এবং সুবিধাভোগীদের পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, ঘুষ গ্রহণ, পছন্দের লোক বা অত্মীয়কে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ ছিল প্রথম থেকেই। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের প্রভাবে অনিয়ম বিষয়ে তেমন আলোচনা হয়নি।

কয়েকটি আশ্রয়ন ঘুরে দেখা গেছে, আশ্রয়নে ঘর বরাদ্দ পাওয়া অনেক পরিবার সেখানে বসবাস করেন না। বিশেষ করে ক্ষমতার দাপটে যারা বরাদ্দ নিয়েছিলেন তারা ঘর ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। অনেক বন্ধ ঘরে বসছে মাদকের আসর। বসবাসের অনুপ্রযোগী পরিবেশের কারণে আশ্রয়ন ছেড়ে অন্যত্রে বসবাস করছেন অনেকে।
অভয়নগরে উপকারভোগী এক পরিবারের ৮০ হাজার টাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর বিক্রি করেন বলে অভিযোগ ওঠে । ২০২২ সালের জুনে উপজেলার শ্রীধরপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটেছে।

উপকারভোগী তরিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী খাদিজা বেগমের নামে বরাদ্দ ঘরের দলিল ওই প্রকল্পের পাশে বসবাসকারী মৃত এহিয়া মোল্যার ছেলে হাসানুর মোল্যার কাছে হস্তান্তর করা হয়। ধারের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ঘরের দলিল ও স্ট্যাম্প দিয়ে দেন বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি।

যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ভবানীপুর আশ্রয়নের বেশিরভাগ ঘর তালাবদ্ধ। একজনের বরাদ্দ পাওয়া ঘরে আর একজন বাস করছেন এমন সংখ্যা বেশি। কেউ ভাড়া হিসেবে কেউ বা লিজ হিসেবে ঘরে বসবাস করছেন।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়ার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১১২ ঘরের বাসিন্দাদের জন্য রাখা হয়নি পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। আবার ঘরের বারান্দার উচ্চতা ও রাস্তা সমান হবার কারণে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকে পড়ে। আছে খাবার পানি সংক । নেই কোন ডাস্টবিন। এসব সমস্যার কারণে কয়েকটি পরিবার তাদের অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে যশোরের মণিরামপুরে একজনকে ৬টি ঘর, একজনকে ৪টি ঘর, আরও ২ জনকে ৩টি করে ঘর বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ভূমিহীন পরিচয়ে আলতাফ হোসেন বাগিয়েছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের ছয়টি ঘর। তিনটি ঘরে লাগিয়েছেন এসি। মেঝেতে করেছেন টাইলস। দুই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। মনিরামপুরের হরিহরনগর ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে তার বাস। অভিযোগ উঠেছে, ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাসহ সংশি¬ষ্টদের ম্যানেজ করে এসব ঘর বাগিয়েছেন তিনি। এরপর নিজেদের মত করে সাজিয়েছেন। কথিত ভূমিহীন এ পরিবারের বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে এলাকায় সমালোচনা চললেও আলতাফ হোসেনের দাবি, প্রকৃত ভূমিহীন হিসবেই তারা ঘর পেয়েছেন। স্বচ্ছলতা ফেরায় শখ পূরণ করেছেন।

এ বিষয়টি অনুসন্ধানে একটি কমিটি করেছে প্রশাসন। কমিটির রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবুর রহমান কলোনি প্রথা চালু করে অনেককে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

যশোরের শার্শা, নাভারণে সে সময়ের বড় তিনটি কলোনি রয়েছে। এগুলোর বাসিন্দারা আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট হিসেবে সব সময় বিবেচিত হয়। একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ। তার প্রকল্পের নাম ছিল গুচ্ছ গ্রাম। এই গুচ্ছ গ্রামের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে জাতীয় পার্টির সমর্থক সংখ্যাও বেশি ছিল। সাতক্ষীরায় জাতীয় পার্টির প্রভাবের পেছনে গুচ্ছগ্রামের ভূমিকা ছিল। এই ধারবাহিকতায় শেখ হাসিনার আশ্রয় প্রকল্পও আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে করা হয় বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা।

যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সাবেরুল হক সাবু বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নিজের দলের লোকজনের পুনর্বাসন করেছেন। যশোর ভূমিহীন ঘোষণা করা হলেও বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত কেউ কোন ঘর পায়নি। ওই সময় ঘর বরাদ্দ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।
যশোর সদরের গোপালপুর আশ্রয়নটি এখন মাদক ব্যবসায়ের কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। ঘর পাওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে অধিকাংশই অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত। স্থানীয়দের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব হচ্ছে নিত্যদিন।

সরকারি ঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয়করণ ও অনিয়ম বিষয়ে জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম জানান, সে সময়ের সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ঘর বরাদ্দ দেয়ার কথা। দলীয় বিবেচনায় ঘর পেলেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হবে না যদি তারা প্রকৃত ভ’মিহীন ও গৃহহীন হয়ে থাকেন। যদি অনিয়মের মাধ্যমে কেউ পেয়ে থাকেন, তদন্ত সাপেক্ষে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে মণিরামপুরে একই পরিবার ৬টি ঘর নিয়ে এসি লাগিয়ে বসবাসের খবর প্রশাসনের দৃষ্টিতে এসেছে। তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একইভাবে পরে যদিও এমন প্রমাণ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।