প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়ে জগন্নাথ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ কেরাণীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়াসহ তিন দাবিতে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হয় এবং এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। সেখানে অবস্থান করে দাবিদাওয়া তুলে ধরার পর দুপুর ১টার পর তালা খুলে নেয় তারা।

এসময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া জগন্নাথের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণ কাজের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ আলী আহমেদকে পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনকারীরা।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে এই আন্দোলনের সংগঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা ‘আমরণ অনশনে বসবে’। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ।

প্রশানসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা ‘দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের আবাসন, কবে দিবে প্রশাসন?’, ‘মূলা না ক্যাম্পাস? ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাস’, ‘সব শালারা বাটপার, আর্মি হবে ঠিকাদার’, ‘যত পারো রক্ত নাও, সেনাবাহিনীর হাতে ক্যাম্পাস দাও’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে; রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘জমি নিতেই ৬ বছর, হল হতে কয় বছর?’, ‘টেন্ডারবাজ প্রশাসন চলবে না, চলবে না’, ‘মুলা ঝুলানো প্রশাসন, চলবে না, চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগন দেন এবং তিন দফা দাবিও তুলে ধরেন।
শিক্ষার্থীরা পিছু হটবে না’ মন্তব্য করে আন্দোলনের মুখপাত্র পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ আবর্তনের শিক্ষার্থী তৈসিব মাহমুদ সোহান বলেন, ”আমাদের দাবি আদায় করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। উপচার্য স্যার দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, নিয়ম-কানুনের অজুহাত দিয়ে আবারও যে আমাদের মুলা ঝুলাবেন এটা পরিষ্কার। “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে প্রজেক্ট ডিরেক্টর সৈয়দ আলী আহমেদকে পদত্যাগ করতে ২৪ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দেওয়া হল। উনি যদি আমাদের আল্টিমেটাম মেনে না নেয়, কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীরা এর দায়ভার নেবে না। আমাদের তিন দফা দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা পিছু হটব না, যদি প্রয়োজন হয় জুলাই আন্দোলনের মত আমরা আবারও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে প্রস্তুত।”

তাদের তিন দফা দাবি হল– ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রকল্প পরিচালককে আইনের আওতায় আনা, সাত দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর দক্ষ অফিসারদের হাতে নির্মাণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই ঘোষণা দিয়ে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার রূপরেখা স্পষ্ট করা।

দ্বিতীয় দাবি হল অবিলম্বে ক্যাম্পাসের জন্য অবশিষ্ট ১১ একর জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া। আর পুরাতন ক্যাম্পাস নিয়ে বিগত সরকারে আমলে করা সব চুক্তি বাতিল করা তাদের তৃতীয় দাবি।

আন্দোলনের সংগঠক রাকিব বলেন, “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এতটা অথর্ব যে তারা এত বছর পরেও জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে পারেনি। তারা শিক্ষার্থীদের গার্মেন্টকর্মীতে রূপান্তর করেছে। আমরা গার্মেন্টকর্মীদের মত সকালে গাড়িতে চড়ে আসি আবার বিকেলে চলে যাই। আমরা আর তা হতে দেব না। আমরা অধিকার আদায়ে রাজপথে নেমেছি, আমরা দাবি না মানা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না; প্রয়োজনে আমরণ অনশন করতে হলে আমরা তা করব।“

এসময় ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অফিস সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “আমি প্রশাসনের কাছে দাবি জানাব, আপনারা আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেন। আমাদের দাবিগুলো না মানলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।“

২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রেখেছে। আমরা আপনাদের এই মুলার নাটকে বিশ্বাস করি না। আমরা আপনাদের বলতে চাই ‘এ তো ব্যাস ট্রেইলার হে, পিকচার আবহি বাকি হে মেরা দোস্ত’।“

এই আন্দোলন নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে প্রত্যেক বিভাগের ক্লাসে ক্লাসে জনসংযোগ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনের মুখপাত্র সোহান।

সড়ক অবরোধ থেকে পিছু হঠল আন্দোলনকারীরা:
আগের দিন সোমবার শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে পৌঁছে সেখানে সড়ক অবরোধ করেন। ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থান করার পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারা ক্যাম্পাসে ফিরে যান।

মঙ্গলবারও সড়ক অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামি মহাসম্মেলন চলায় তারা কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনা। তাই ক্যাম্পাসের মধ্যেই মিছিলটি সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

আন্দোলনের মুখপাত্র তৌসিব মাহমুদ সোহান বলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামি মহাসম্মেলন চলায় এমনিতেই পুরো ঢাকা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। তাই আমরা আমাদের কর্মসূচি তাঁতীবাজার না গিয়ে ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ রেখেছি।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আবাসিক হলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের সিদ্ধান্ত জানায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।

অ্যাকাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, আবাসন ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, চিকিৎসা কেন্দ্র, সুইমিংপুল, লেক নির্মাণসহ উন্নতমানের ক্যাম্পাস তৈরির মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেঘরিয়ার পশ্চিমদি মৌজায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর জমির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। ৯ অক্টোবর নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে একনেক। এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে।

২০১৯ সালের জুলাইয়ে নতুন ক্যাম্পাসের নকশাও দেখানো হয় ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ওই বছরের জুলাইয়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার চেক পায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পরের বছর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি মোট ২০০ একর জমির মধ্যে ১৮৮ দশমিক ৬০ একর জমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে পায়। কিন্তু এখনও অবশিষ্ট ১১ দশমিক ৪০ একর জমি বুঝে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে তেঘরিয়া গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ সীমানা প্রাচীরের কাজ এখনও বাকি আছে। লেক নির্মাণ শেষ হলেও তা এখনও বুঝে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়। লেকের পাড়ে মাটি আটকে রাখার জন্য পাথর ব্যবহার করলেও বর্ষার বৃষ্টিতে এবং পাড়ে গবাদিপশু বিচরণের কারণে মাটি ধসে লেকের কিছু জায়গা আবার ভরাট হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় আটকে যায় মাটি ভরাটের কাজ। তবে ঘাট নির্মাণের কাজ হয়েছে। এছাড়া আর কোনো কাজই শুরু হয়নি।

প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে তা সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে এ সময়ের মধ্যেও প্রকল্প শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান শিক্ষার্থীরা।