মারুফ কামাল খান।। তাদের সকলেই যে কঠিন আওয়ামী লীগার তা’ কিন্তু নয়। নরোম আওয়ামী লীগারও আছে। ফ্যাসিবাদী নয় এবং অন্যমত, ভিন্নমত ও বহুমতের প্রতি সহিষ্ণু আওয়ামী লীগারও কেউ কেউ রয়েছে আমাদের সমাজে। থাকতেই পারে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কেবল ফ্যাসিবাদকে যারা রাষ্ট্রে, সরকারে ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তারা নিষিদ্ধ থাকবে। আমরা আর ফ্যাসিবাদকে ফিরে আসতে দেবো না। যারা একদল, একমত, একবয়ান ও একচিন্তার বাইরে আর কোনোকিছুই সহ্য করতে বা মানতে পারে না, বিলুপ্ত বা ধ্বংস করে দিতে চায়, আমাদের রাষ্ট্রীয় সমাজে তাদের আর কোথাও কখনো ঠাঁই হবে না। এটাই সদ্যজয়ী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষা।
আমরা রাজনীতির নামে হত্যাযজ্ঞ, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও জবরদস্তিকে ফিরিয়ে আনতে দেবো না। আমরা চাপিয়ে দেয়ার রীতিনীতিতে বিশ্বাস করিনা। আমরা সমাজে সব মতের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার উপযোগী এক সহিষ্ণু পরিবেশ চাই। চাই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করতে।
উপরের কথাগুলোর আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আটটি ‘জাতীয় দিবস’ বাতিল করে দেয়ার সিদ্ধান্তকে পাঠ ও পর্যালোচনার পক্ষপাতি আমি। আচ্ছা, বলুন তো ঐযে নানান উপলক্ষের আটটি দিবস রাষ্ট্রীয় উদযোগে উদযাপিত হয়ে আসছিল, সেগুলি কি আদপেই ‘জাতীয়’ চারিত্র্যের ছিল? এগুলি উদযাপনে তো রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদ ও শ্রম-মেধা খরচ হতো এবং ওইসব দিবসকে কেন্দ্র করে সুবিধাভোগীরা বাণিজ্য-বেসাতি করে মালকড়িও কামাতো। কিন্তু দিবসগুলির ব্যাপারে বর্ণিত মাহাত্ম্য নিয়ে সমাজে কি ঐক্যমত ছিল? সকলের সম্মতির ভিত্তিতে কি ওই দিবসগুলোকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল? মোটেও তা’ নয়।
হ্যাঁ, সমাজের সকল হার্ড ও সফট আওয়ামী লীগার এবং তাদের সমচিন্তার লোকেরা নিশ্চয়ই ওই দিনগুলোকে মহিমাময় এবং জাতীয়ভাবে উদযাপনযোগ্য বলে বিশ্বাস করে। তাদের মনে করার ওপর ভর করেই আওয়ামী লীগের সরকার ওই দিবসগুলোকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে তা’ প্রতিপালিত হয়ে আসছিল। দেশ ও সমাজের আর সকলেই এটা মনে করে কিনা, মেনে নেয় কিনা এবং এর বাইরেও আর কোনো মত ছিল বা আছে কিনা আওয়ামী লীগ তা ভাবার বা গ্রাহ্য করার প্রয়োজনও মনে করেনি। জাতীয় ঐক্যমত ছাড়া এভাবে সবকিছু সকলের ওপরে চাপিয়ে দেয়ার যে রীতি সেটাই অগণতান্ত্রিক এবং এই প্রবণতাই ফ্যাসিবাদী।
যে আটটি উপলক্ষকে জাতীয় দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয় উদযোগে উদযাপনের ব্যাপারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অস্বীকৃতি জানিয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ৭ই মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণের দিন, ১৭ মার্চ মুজিবের জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস এবং ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।
খুব নির্মোহ ও নিরাসক্ত চোখে তাকালে দেখা যায় যে, এই দিবসগুলোর বেশিরভাগই একটি পরিবারকেন্দ্রিক। কেবল ব্যক্তিপূজা বা একদলীয় চিন্তা নয়, একটি পরিবারকে বিশিষ্টতা দেওয়া এবং সেই বিশেষ পরিবারকে বন্দনা করার পৌত্তলিক চিন্তা থেকেই পুরো জাতির ওপর ওই দিবসগুলো পালনের দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। পতিত ও ভারতে পালিয়ে যাওয়া ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মা ও ভাইদের জন্মমৃত্যুর দিনকেও ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালনের এই সিদ্ধান্ত কি সুস্থ মস্তিস্কপ্রসূত বলে মনে হয়?
বিশ্বে একটিমাত্র রাজনৈতিক পরিবার ট্রাজেডির শিকার হয়নি। এমন উদাহরণ জগতে অনেকই আছে। কিন্তু তাই বলে পুরো পরিবারটিকে জাতীয়ভাবে বন্দনাযোগ্য করে ফেলার চিন্তা মধ্যযুগীয় ও রাজতান্ত্রিক। হাসিনার নেতৃত্বে জনসম্মতিহীন আওয়ামী সরকার সেটাই করেছিল এবং এই জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্ত ফেলে দেয়াই গণতন্ত্র, সভ্যতা ও আধুনিকতার দাবি। অন্তর্বর্তী সরকার সেটাই করেছে।
পারিবারিক এই দিবসগুলো এখন পরিবারের বাইরেও ভক্তরা কেউ ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক উদ্যোগে পালন করতে চাইলে তা’ অবশ্যই করতে পারবে। তাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা আপত্তি নেই। তবে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালনের লিস্টি থেকে কেবল এই দিবসগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
হাসিনা রেজিমের চাপিয়ে দেয়া এই সিদ্ধান্ত বাতিলের মাধ্যমে ভিন্নমতের মানুষদের অস্বস্তি দূর করা হয়েছে। তবে ভক্তকূলদের মতামত ও স্বাধীনতার ওপরেও কোনো হস্তক্ষেপ করা হয়নি। তারা চাইলেই দিবসগুলো ভক্তিভরে পালন করতে পারবে। ফলে এই বাতিলের সিদ্ধান্ত কিন্তু আসলে মতবৈচিত্রেরই স্বীকৃতি এবং এতে জাতীয় ঐক্যের পথই খুলবে। জবরদস্তিমূলকভাবে সবার ওপর চাপানো সিদ্ধান্ত কিন্তু ঐক্যের চেতনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটা একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াসের মতই হাস্যকর।
কেউ কেউ জাতীয় দিবস হিসেবে পালনের তালিকা থেকে সাতই মার্চকে ছেঁটে ফেলায় আহত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন। আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পথযাত্রার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য দিনগুলোর মধ্যে ৭ই মার্চ অন্যতম। তবে এই দিনটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অবিসংবাদিত নয়। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সমাবেশ ছিল মূলতঃ পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা ও বিভিন্নস্থানে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। শেখ সাহেব তার বক্তৃতায় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে চার দফা দাবি পেশ এবং দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি তার বক্তৃতা শেষ করেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ এই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করে।
শেখ সাহেবের উচ্চারণ করা এই স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে কেউ কেউ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইংগিতবহ বলে মনে করেন। জাতীয় ইতিহাসের আরেক নায়ক জিয়াউর রহমানের কাছেও ওই বাক্যটিকে আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিসারী ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বা সবুজ সংকেত বলে মনে হয়েছিল। একই ভাষণে শেখ সাহেব উপসংহারে জয় পাকিস্তান বা জিয়ে পাকিস্তান ধ্বনিও উচ্চারণ করেছিলেন বলে একটি ঐতিহাসিক ভাষ্য চালু আছে। সে বিতর্কের কথা বাদ দিলেও মার্চের তৃতীয় ও শেষ সপ্তাহে শেখ সাহেব পাকিস্তানের সংবিধান রচনা সম্পর্কিত বিরোধ ও বিতর্ক নিষ্পত্তির জন্য ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে লাগাতার বৈঠক করেন এবং আলোচনায় অগ্রগতির কথাও জানান।
পরবর্তীকালে তার এই ভূমিকার কারণে অনেকেই মনে করেন যে, ৭ই মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের কথা বলে শেখ সাহেব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেননি। বরং তিনি পাকিস্তানি কাঠামোর ভেতরেই দেশবাসীর বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথাই বুঝিয়েছিলেন। তার মানে, ৭ই মার্চের নানান রকম ব্যাখ্যা রয়েছে এবং তা অবিতর্কিত নয়। কাজেই জাতীয় দিবস না করেও ৭ই মার্চকে প্রত্যেকে যে-যার মতো করে পালন করতে পারেন।
এরপর আসে শেখ মুজিবের কথা। তাকে জাতির পিতা হিসেবে মান্য করার ব্যাপারে কোনো জাতীয় ঐক্যমত গড়ে ওঠেনি। অনেকে সকলের অবদানকে সমন্বিত করে জাতীয় নেতাদেরকে মিলিতভাবে ‘রাষ্ট্রের স্থপতি’ রূপে মর্যাদা দিতে চান। কেউ কেউ জাতির পিতা ধারণারই বিরোধী এবং এটিকে অনাবশ্যক মনে করেন। তাছাড়া, গত দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা হাসিনা রেজিম জোর করে শেখ মুজিবের নামে এক ধরণের ‘কাল্ট’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। সরকারি ফরমানে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার সমালোচনা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেখানে সেখানে মুজিব-মূর্তি ও কর্নার স্থাপন করে একপ্রকার বাধ্যতামূলক ব্যক্তিবন্দনা ও বীরপূজার প্রবর্তন করা হয়েছিল। হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী রীতিনীতির প্রেরণার উৎস রূপে মুজিবের নাম তারস্বরে প্রচার করে নতুন প্রজন্মের কাছে তার ভাবমূর্তিকে ফ্যাসিবাদের আইকন হিসেবে ঘৃণিত করে ফেলেছে। হাসিনা রেজিমের পতনকালে সেই ঘৃণা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি।
এরকম একটি সময়ে শেখ মুজিবের জন্ম ও নিহত হবার দিনটিকে রাষ্ট্রীয় উদযোগে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করাটা বেশ অস্বস্তিকর বৈকি। কাজেই এ ক্রান্তিকালে জাতীয় তালিকা থেকে বাদ দিয়ে মুজিবের জন্ম-মৃত্যুদিনকে স্বাধীনভাবে যার যার মতো করে উদযাপনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়াকে বিজ্ঞ সিদ্ধান্তই বলতে হবে। কালের পরিক্রমায় জনচিত্তের ক্ষোভ ও ঘৃণা থিতিয়ে এলে ইতিহাস যদি মুজিবকে আবারো জাতীয় মহিমায় অধিষ্ঠিত করে তাতে কারুর কিছু বলার থাকবে না। তবে বর্তমান স্পর্শকাতর সময়ে কোনো ব্যাপারেই নাছোড়বান্দা ও হঠকারী না হয়ে বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-বিভাজন পাশ কাটিয়ে দ্বান্দ্বিক মতামতগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হওয়া উচিত আমাদের পথ।
লেখক পরিচিতি : মারুফ কামাল খান : লেখক-সাংবাদিক, বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেসসচিব।