আবু নাসের অনীক || ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানটি ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে শুরু হলেও পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলসমূহ,ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সাধারণ জনতা। তবে নেতৃত্বে থেকেছে ছাত্রসমাজ। সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, বেঞ্চ বিচারপতি নিয়োগ থেকে শুরু করে সরকারের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সরাসরি প্রভাব বিস্তার করেছে। সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যানার এবং তরুণ প্রজন্মের চিন্তার প্রতিফলন হিসাবে এটাকে জনগণ প্রথম দিকে ইতিবাচক হিসাবেই গ্রহণ করেছে। কিন্তু সরকার এবং তাদের বর্তমান কর্ম তৎপরতায় এক ধরণের আশঙ্কাবোধের সৃষ্টি হচ্ছে।
যে পদ্ধতিতে এবং যে সমস্ত বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে তারা অ্যাক্ট করছে সেটির সাথে জনতুষ্টিবাদ বা পপুলারিজম এর বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করি জনতুষ্টিবাদ কী? জনতুষ্টিবাদ শুধুমাত্র একটি মতামত গ্রহণ করে। তাদেও দৃষ্টিতে, তারাই একমাত্র এই মতামতটি জানে এবং বুঝতে পারে, তাই তারাই একমাত্র যারা জনগণের প্রয়োজনে দাঁড়াতে পারে। এটিই জনতুষ্টিবাদের দার্শনিক ভাবনা। তাদের কাছে এই ‘জনগণ’ সিলেকটিভ। জনগণের মধ্যে যারা তাদের অনুসারী হবে এবং তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপকে ইতিবাচকভাবে দেখবে ও প্রশংসা করবে-শুধুমাত্র তাদেরকেই তারা প্রকৃত জনগণ হিসাবে মনে করবে। এর বাইরের অংশ তাদের দৃষ্টিতে জনগণের কাতারে পড়বে না।
এই অংশটিকে তারা সাধারণত ষড়যন্ত্রকারী বা চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। সেজন্য দেখা যায়, কোন জনতুষ্টিবাদী শাসক যখন প্রভূত ক্ষমতার মালিক হয়, তখন তাদের কর্তৃত্ববাদী চেহারা প্রকাশিত হয়। এরফলে তারা জনগণের অনেক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। বিভিন্ন চটকদারী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তারা জনগণের সামনে সবসময়ের জন্য দৃশ্যমান থাকতে চায়। নিজেদের অপরিহার্যতাকে গ্রহণীয় করে তোলার জন্য কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলা হলেও ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
নিজেকে সবার সেরা মনে করা এবং জোর করে নিজেকে জনপ্রিয় করে রাখার এক ধরণের প্রচেষ্টা অব্যহত থাকে। পপুলারিজমকে একারণে গণতন্ত্রে উত্তরণে ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি বাধা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্রে নানা পথ ও মতের মিথস্ক্রিয়াতে নেতৃত্ব বিকাশের যে সম্ভবনা থাকে এখানে সেই পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়। একটি চরমপন্থী অভ্যূত্থানের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পপুলারিস্টদের উত্থান ঘটে। সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে নতুন চেতনার বিকাশ ঘটানোর প্রয়াস নেওয়া হয়। বিভিন্ন ধরণের স্পর্শকাতর এবং ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে নতুন নির্মিত চেতনার সাথে মিলিয়ে একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়। যেই ব্যবস্থাপনার অধীনে কোন ধরণের কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রাখা হয় না।
নিজেদের ইচ্ছামতো গড়ে তোলা এই চেতনা কাঠামোর মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামো সৃষ্টি করা হয়। যার সর্বশেষ গন্তব্য হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদে। আমার উপরের আলোচনার ধারাবাহিকতাতে ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং সরকারের তৎপরতা মিলিয়ে দেখার অনুরোধ করবো। ইতিমধ্যে তারা তাদেরকেই জনগণ মনে করছে যারা তাদের কার্যক্রমকে শর্তহীনভাবে প্রশংসা করছে। যারা শর্তহীনভাবে প্রশংসা করছে না তারা তাদের কাছে চক্রান্তকারী এবং ‘দালাল’ হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এখন দেশের প্রভূত ক্ষমতার মালিক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
সেই ক্ষমতাবলে তারা ডিসি নিয়োগে পর্যন্ত ভূমিকা রাখছে। প্রথম চালানে ডিসি নিয়োগের তালিকা করেন তৎকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন অধিশাখার যুগ্মসচিব কেএম আলী আজম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি ছাত্র সমন্বয়ক তানভীরের সাথে পরামর্শ করে ডিসি নিয়োগের তালিকা করেন। কেএম আলী আজম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো সমন্বয়কের সঙ্গে মিটিং করিনি। তিনি আমার কাছে আসেন। আমি তো ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডাকিনি। কেউ এলে তাকে কি নিষেধ করা যায়।
’ সমন্বয়ক দাবিদার তানভীর যুগান্তরকে বলেন, বিগত আন্দোলনে আমাদের ভূমিকা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। প্রশাসনের কোথায় কাকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা দেখার কিংবা জানার অধিকার আমাদের আছে। এ কারণেই এখানে আসতে হয়।’ কেএম আলী আজম সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং জামায়তপন্থি আমলা। (১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪-যুগান্তর)।
ক্ষমতাবলে সমন্বয়করা সরকারের প্রটোকল ব্যবহার করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে বিভাগ ও জেলা সফর করেছেন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেছেন, ‘কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক সভা করতে সমন্বয়করা জেলা সফর করছেন না। ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পরিবারের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জেলা সফর করছেন’ (১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪-বাংলাদেশ প্রতিদিন)। কিন্তু তারা প্রতিটা জেলা সফরে গণসমাবেশ করেছেন, রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেছেন, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রতিটা জেলাতে ডিসি-এসপি’র উপস্থিতিতে সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করেছেন।
আমাকে বলবেন কি এই তৎপরতার সাথে ‘শহীদ পরিবারের কাছে দায়বদ্ধতার’ সম্পর্ক ঠিক কি?
এই সবকিছুই তো সাংগাঠনিক তৎপরতা! দুইমাস না যেতেই প্রতারণামূলক বক্তব্য দেওয়া শিখে ফেলেছেন। ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’এর ব্যানার সক্রিয় রেখে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে প্রশাসনকে বাধ্য করছেন। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হলে উঠতে চাইলে এখন আপনাদের স্লিপ ছাড়া ওঠা যাচ্ছে না। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার ১৭ জন পদত্যাগকারী সমন্বয়ক- আপনাদের সম্পর্কে বলেছেন,‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের মতো ভূমিকা পালন করছে। ফলে আমরা মনে করি, এই ব্যানার এখনো বজায় থাকা আন্দোলনে সর্ব পেশার, সর্বস্তরের ও সর্ব দলের মানুষের অংশগ্রহণের ইতিহাসকে ম্লান করে দিচ্ছে। তাই এই ব্যানার যত দ্রুত সম্ভব বিলুপ্ত করে দিতে হবে।’(০৩ অক্টোবর ২০২৪- প্রথম আলো)
এসব প্রতিক্রিয়া আমাদের প্রধান উপদেষ্টার কানে ঢুকছে না। উনি নিতে চাচ্ছেন না। যেমন করে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নিতেন না। একটু মিলিয়ে দেখুন, প্রবণতাগুলো খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। সংস্কার কাজের মধ্যে সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংস্কার কমিশন; সেখানে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিককে নির্বাচিত করে তাকে ১০ দিনের মধ্যে পরিবর্তন করে অধ্যাপক আলী রিয়াজকে নিয়োগ প্রদান করলেন। কিসের ভিত্তিতে তাকে এখানে নিয়োগ দিলেন?
অধ্যাপক আলী রিয়াজ গত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী রেজিমের বিরোধীতা করে গণমাধ্যমে নানাভাবে কথা বলেছেন। নিঃসন্দেহে উনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক হিসাবে অভিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সেই হিসাবে উনি সংবিধান সম্পর্কেও ভালো বুঝেন। কিন্তু উনি সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসাবে কিন্তু পরিচিত বা স্বীকৃত নন। এ বিষয়ে তার লেখালেখিও নাই।
এটা পূর্ব থেকেই কথিত জনাব প্রধান উপদেষ্টা আপনি মার্কিন লবির লোক। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ‘ক্লিনটন ইনসিয়েটিভে’ আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আপনার সম্পর্কে যে পারসেপশন আছে সেটাকে আরো কংক্রিট করেছেন আপনি নিজেই।
এমন একটি পরিস্থিতিতে মার্কিন নাগরিক অধ্যাপক আলী রিয়াজকে আপনি বেছে নিলেন বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন কমিশনের প্রধান হিসাবে। যিনি গত ৪০ বছর ধরে দেশে থাকেন না। যার মূল কাজ ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ বিষয়ে। তিনি নিজে সংবিধান পূর্ণলিখন চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। সেটা ইতিমধ্যেই পাবলিকলি বলেছেন। পূর্ণলিখন না সংশোধন বা পূর্ণলিখন হলেও সেটা এই সরকারের করার এক্তিয়ার আছে কি না সেসব নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। সেই প্রেক্ষিতে একটি চিন্তার পক্ষের ব্যক্তিকে কিভাবে কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিলেন? অধ্যাপক আলী রিয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র অনাবাসিক ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস) প্রেসিডেন্ট।
আটলান্টিক কাউন্সিল কি?
“১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক কাউন্সিল ২১ শতকের আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আটলান্টিক কমিউনিটির কেন্দ্রীয় ভূমিকার উপর ভিত্তি কওে গঠনমূলক মার্কিন নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে জড়িত থাকার প্রচার করে। কাউন্সিল নেতাদের একটি নির্দলীয় নেটওয়ার্ককে মূর্ত করে যারা ধারণাগুলিকে ক্ষমতায় আনতে এবং ধারণাগুলিকে ক্ষমতা প্রদানের লক্ষ্য রাখে: প্রশাসন, কংগ্রেস, কর্পোরেট এবং অলাভজনক সেক্টওে এবং মিডিয়ার নেতাদের মধ্যে সমালোচনামূলক আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলি সম্পর্কে সংলাপ এবং আলোচনাকে উদ্দীপিত করে। এটি ন্যাটোর থিংক ট্যাংক হিসাবে কাজ করে।
জুলাই ২০১৯ সালে, রাশিয়া বলেছিল যে, আটলান্টিক কাউন্সিলের কার্যক্রম তার সাংবিধানিক ব্যবস্থার ভিত্তি এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। রাশিয়া আটলান্টিক কাউন্সিলকে তার “অবাঞ্ছিৎ”; সংস্থার তালিকায় যুক্ত করেছে, এটি রাশিয়ার মধ্যে কাজ করা থেকে বিরত রেখেছে। আন্দ্রেই তেসিগেনেকভ,পাভেল তেসিগেনেকভ, এবং হেলি গঞ্জালেস (২০২৩) আটলান্টিক কাউন্সিলের প্রকাশনায় ন্যাটো-পন্থী এবং রুশ-বিরোধী পক্ষপাতের কথা উল্লেখ করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপলোমেটিক কেবল তথ্য ফাঁস প্রকাশ করে বলে, আটলান্টিক কাউন্সিল শেভরন এবং এক্সনমোবিল প্রতিনিধিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে যাতে ব্রাজিলীয় উপকূলে প্রাক-লবণ তেল সঞ্চয়ের প্রধান অপারেটর পেট্রোব্রাসকে মঞ্জুর করার জন্য ব্রাজিলীয় আইনসভা প্রস্তাবকে দুর্বল করে দেয়। ব্যর্থতার পর, সংগঠনটি সেই প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করার জন্য প্ররোচিত করে যারা দিলমা রুসেফের অভিশংসনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে। আপনাদের কাছে আটলান্টিক কাউন্সিল এর গ্লোবাল ভূমিকা সম্পর্কে এত কথা বলার জন্য হয়তো মনে হতে পারে আমি ‘ধান ভানতে শীবের গীত’ গাইছি।
আলোচনা করার কারণ অধ্যাপক রিয়াজ এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে নিবিড়ভাবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যুক্ত থাকার পরেও দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয় সংবিধান সংশোধন কমিশনের প্রধান করে দিলেন শাহদীন মালিককে পরিবর্তন করে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, “আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন, ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়নি। তার মূল কৃতিত্ব যেতে পাওে আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে প্রতি” (২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪-ঢাকা ট্রিবিউন)। তেলের গ্যালনের ঢম থেকে উনি ডালা শুরু করেছেন। ওনার নিয়োগের প্রস্তাবনা করেছিলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এ সময়ে সারা দেশে কমপক্ষে ৪৯টি এমন হত্যাকান্ড ঘটেছে, কারণ, বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া যে-কোনোভাবে যে-কোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড৷’(৪ অক্টোর-ডিডাব্লিউ)। বুঝেন দেশের পরিস্থিতি।
সরকার এবং ছাত্র তারা যে আচরণ প্রদর্শন করছে সেটি চরম কর্তৃত্ববাদীতার সামিল। সরকার বা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম সম্পর্কে কোন ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করলেই কিছু কমন ডায়লগ দেওয়া হচ্ছে সেই সিলেক্টিভ ‘জনগণ’ এর পক্ষ থেকে। বক্তব্যগুলি এমন,‘এখন বিভেদের সময় নয়, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়ার’; ‘১৫ বছর ধওে প্রশ্ন করেন নাই, এখন কেন প্রশ্ন করতে হবে’; অথবা ফ্যাসিস্টের ‘দালাল’; বলে ট্যাগ দেওয়া। এমন আরো নানা ধরণের কথা। এধরনের কথা জনতুষ্টিবাদকে রক্ষা করে।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম,জনতুষ্টিবাদ এমন ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে চায় যার অধীনে কোন ধরণের কোন প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রাখা হয় না। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রশ্ন করাটা খুবই জরুরি। যতো প্রশ্ন করা হবে ততোই সঠিকভাবে তার কর্মকান্ড পরিচালনায় সেটি সহায়ক হবে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার সহস্র প্রাণের বিনিময়ে পতন ঘটেছে; সেই সরকারটি প্রাথমিক অবস্থায় জনতুষ্টিবাদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিলো। স্বাভাবিকভাবেই একটি পর্যায়ে তারা ফ্যাসিবাদে টার্ন করে। একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নেতৃত্ব পতন ঘটায় সেই নেতৃত্বেরও জনতুষ্টিবাদে ভুগে আবারও ফ্যাসিবাদে টার্ন করার সমূহ সুযোগ থাকে। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার নজির আছে।
বিভিন্ন জায়গাতে যেখানে জনতুষ্টিবাদের আধিপত্য দেখা গেছে জনগণের সন্তুষ্টি বিধানের শ্লোগানকে ভিত্তি করে; সেখানেই জনবিক্ষোভের কারণে তাদের বিনাশ হয়েছে। কিন্তু জনগণের এই উন্মত্ততার মধ্যেও আবার কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক জনতুষ্টিবাদী চরিত্র সৃষ্টি হয়ে যায়।
জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এরা নিজেদের জনতুষ্টিবাদী আচরণ প্রকাশ করতে থাকে। এদের নির্দিষ্ট কোন আদর্শ বা দর্শন থাকে না। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন এর অনুপস্থিতিতে বিগত জনতুষ্টিবাদীদের জায়গায় নতুন জন্ম নেওয়া জনতুষ্টিবাদীদের উত্থান পাল্টা একটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি চাইছি তার জন্য আমাদের কাঠামোগত সংস্কার জরুরি এই মুহূর্তের বাস্তবতায়। কিন্তু অতি অবশ্যই এই প্রক্রিয়ার সাথে দেশের ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে যুক্ত করতে হবে। আগামী দিনের রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জসমূহ তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ওয়েআউট তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে।