হিটার নয়ন, মোস্তফা, রনি-তন্বী, শুভ বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল শংকরপুর ও বেজপাড়ার মানুষ

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বরাবরই অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত যশোর পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শংকরপুর-বেজপাড়ার একাংশ। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসন- মিলে কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি ছিলেন। খুন, চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো।

ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে সন্ত্রাসীরা অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। অপরাধকান্ড পরিচালনায় এক গ্রুপ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারকে আবার অপর গ্রুপ সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদকে অভিভাবক হিসেবে মানতো। দলীয় শক্তি প্রদর্শনে নেতারাও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ব্যবহার করতো। নেতাদের বলে বলিয়ান সন্ত্রাসীরা খুন, চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসায়ের পাশাপাশি বিচারেরর নামে জিম্মি করতো।

নতুন বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর নেতারা গা ঢাকা দিলেও কর্মী বাহিনী এলাকায় অবস্থান করছে। আগে দলবদ্ধ হয়ে থাকতো, এখন আলাদা আলাদাভাবে অবস্থা যাচাই করছে। সুযোগ বুঝে কেউ কেউ পুরোনো স্বভাবে ফিরে যাচ্ছে। তাদেরকে আটকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পদক্ষেপ না নেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, আওয়ামী লীগের বিগত ১৬ বছরের শাসন আমলে শংকরপুর ও বেজপাড়ার (একাংশ) মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারেননি। এমনিতেই এই অঞ্চলে অপরাধপ্রবণতা বেশি। তারপর আবার ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফা পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর গোটা এলাকায় সন্ত্রাস জেকে বসে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের অনুসারী এবং কাছের লোক হিসেবে পরিচিত গোলাম মোস্তফার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তার ছোট ভাই গোলাম রসুল ডাবলু এবং ছেলে মিশ্র শংকরপুর এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম কার্যালয়ের কমিটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও এসব সন্ত্রাসীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে ক্ষুব্ধ জনতা ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে ওই কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করেন।

সূত্র জানায়, পৌর কাউন্সিলর গোলাম মোস্তফার ছোটভাই গোলাম রসুল ডাবলু ইয়াবা ট্যাবলেটের বড় ডিলার ছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্র বেচাকেনার সাথেও জড়িত ছিলেন। কয়েক বছর আগে র‍্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা তার বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে অস্ত্রসহ আটক করেছিলেন। কিন্তু মোটা অংকের টাকায় দফারফা হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয় বলে এলাকায় প্রচার রয়েছে। এছাড়া কয়েক বছর আগে গোলাম রসুল ডাবলু এবং মিত্রসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে শংকরপুরে বিএনপি’র নিরীহ কর্মী মশিয়ার রহমান নৃশংসভাবে খুন হন।

সাবেক পৌর কাউন্সিলর গোলাম মোস্তফার অন্যতম ক্যাডার ছিলেন আলোচিত সন্ত্রাসী ভাইপো সাঈদ। শংকরপুর আশ্রম রোডের মহিলা মাদ্রাসার সামনে এই ভাইপো সাঈদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন শহরের সিটি কলেজপাড়ার এক যুবক। এ ঘটনার পর কয়েকদিন পর পৌর পার্কের ভেতর থেকে ভাইপো সাঈদ এবং গোলাম মোস্তফার আরেক ক্যাডার শাওনকে পুলিশ আটকের পর। গুম করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আরেক ক্যাডার পারভেজ পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। গোলাম মোস্তফার আরেক ভাই সিদ্দিক হোসেন শংকরপুর কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল এলাকার ইজিবাইক স্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায় করতো। তাছাড়া গোলাম মোস্তফার ছেলে মিশ্র’র একটি কিশোর সন্ত্রাসী বাহিনী ছিলো।

তুচ্ছ ঘটনায় এলাকার যুবক-কিশোরদের মারধর করতো তারা। শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার নিরীহ যুবদল কর্মী রবিউল ইসলাম গাজীকে গোলাম রসুল ডাবলু দলবল নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল করার কারণে ছুরিকাঘাত এবং ইট দিয়ে আঘাত জখম করেছিলেন এছাড়া আরেক পৌর কাউন্সিলর আলোচিত সন্ত্রাসী শাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়নকে বোমা মেরে হত্যা করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন গোলাম মোস্তফার আরেক ক্যাডার সানি এলাকাবাসী জানান, ভাইপো সাঈদ, শাওন , পারভেজ, সানি, ডেঞ্জার সোহাগ, বনি (আতিয়ারের ছেলে), শয়ন (শফির ছেলে), রুবেল ওরফে মোটা রুবেল, নায়ক মামুন, গোলাম রসুল ডাবলু, মিশ্র, অনি ওরফে অনিকসহ অন্তত ১৫/২০ জন।

এর মধ্যে ভাইপো সাঈদ ও শাওন গুম, পারভেজ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত এবং সানি গণপিটুনিতে মারা গেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গোলাম মোস্তফা এবং সিদ্দিক হোসেন জনরোষের ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। ছোটভাই গোলাম রসুল ডাবলু সদর উপজেলার হাশিমপুরে আত্মগোপন করে রয়েছেন। তবে শয়ন, বনি ও মোটা রুবেলকে এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়রা জানান, গোলাম মোস্তফার পর ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন আলোচিত সন্ত্রাসী শাহেদ হোসেন নয়ন ওরফে হিটার নয়ন। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী হিটার নয়নকে কাউন্সিলর হিসেবে জেতানোর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় জামায়াতে ইসলামের নেতা- কর্মীরা। নয়নের চাচারা জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। হিটার নয়নের বিরুদ্ধে চাঁচড়া বাবলাতলায় ট্রাকের চালক-হেলপার হত্যা মামলা এবং শংকরপুরে তাইজেলের ছেলে রিপন হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।

পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর হিটার নয়ন রাতারাতি শংকরপুর বাসটার্মিনাল এলাকার ইজিবাইক স্ট্যান্ড দখল করে নেন। সেখান থেকে দৈনিক ইজিবাইক প্রতি ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হতো। এলাকায় কেউ জমি ক্রয় করলে বা নিচু জমিতে মাটি ফেললে তার কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করতেন হিটার নয়ন ও তার সহযোগীরা। শংকরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুই জন কর্মচারী নিয়োগের ঘটনায় হিটার নয়ন ১৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তৎকালীন সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের ডিও লেটারে ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি বনে যান। তার সহযোগীরা মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম হলেন, মানিক, জুয়েল, বাপ্পা, ছকু, রিয়ন, বাপ্পি, আজাদ, কুটি, আপন প্রমুখ। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হিটার নয়ন আত্মগোপন করলেও তার সহযোগীরা এলাকায় রয়েছে। শংকরপুর চোপদার পাড়া এলাকায় আরেকটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন চা বিক্রেতা মুজিবরের ছেলে শাহেদ উর রহমান ওরফে রনি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত রনি’র দলীয় কোনো পরিচয় না থাকলেও তার স্ত্রী তন্বীর কারণে গোটা শহরের লোকজন তাকে চেনেন।

তন্বী পুলিশের দালাল হিসেবে পরিচিত এবং অনেক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। পুলিশের খুলনা খুলনা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি দিদার আহম্মেদের সাথে তার গভীর সখ্য ছিলো। ইতোমধ্যে দিদার আহমেদের সাথে তার অন্তরঙ্গ কথোপকথন ইউটিউবে ছড়িয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে মুখরোচক গল্পও রয়েছে। রনি’র ক্যাডারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শংকরপুর আকবরের মোড় এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হুজুর ইয়াসিন। প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী হুজুর ইয়াসিন। রনি’র সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে শংকরপুর পশু হাসপাতাল এলাকার কাজী তৌহিদের ছেলে আলোচিত সন্ত্রাসী ভাইপো রাকিব, বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার সিরাজুল, জনি, চোর আল আমিন, মাদক ব্যবসায়ী শহিদুল, শাহিন, লিটন উল্লেখযোগ্য।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের বেজপাড়া ফুড গোডাউনের দক্ষিণ পাশের আরেক গ্রুপ প্রধান রাকিব ওরফে শুভ আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসন আমলে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী শুভ লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অর্থ আদায় এবং ইয়াবা ট্যাবলেট বেচাকেনার সাথে জড়িত ছিল। সন্ত্রাসী শুভর অন্যতম সহযোগী মন্টু ওরফে অপূর্ব নানা অপরাধের সাথে জড়িত। র‍্যাবের সোর্স হিসেবেও পরিচিত ছিলেন কুখ্যাত সন্ত্রাসী শুভ। ফুড গোডাউনের পাশের একটি মার্কেটের মালিককে নারী দিয়ে ব্লাকমেইলিং করতে গিয়ে বিদেশি পিস্তল ও ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক হয়েছিলেন শুভ এছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।