একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের মৃত্যু “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে হৃদরোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত যশোর”

0

বিএম আসাদ ।। হৃদরোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ২০ বছর আগে যশোরে স্থপিত হয় খুলনা বিভাগের প্রথম বিশেষায়িত হাসপাতাল। নাম দেয়া হয় করোনারী কেয়ার ইউনিট। ভবন নির্মাণ ও হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশ্বমানের যন্ত্রপাতির বরাদ্দ নিশ্চিত হলেও জনবল নিয়োগের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয় বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের।

এ হাসপাতালটির স্বপ্নদ্রষ্টা যশোরের প্রাণ পুরুষ উন্নয়নের কারিগর তরিকুল ইসলাম হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার যন্ত্রপাতিগুলোকে বাক্সবন্দী করে হাসপাতাল ভবনটাকে প্রথমে করে মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাস, পরে আড়াইশ শয্যা হাসপাতালের কার্ডিয়াক ওয়ার্ডে রূপ দেয়। এভাবেই ‘হত্যা’ করা হয় একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের। অভিজ্ঞজনরা বলছেন, হাসপাতালটি  চালু হলে হৃদরোগীদের ঢাকা খুলনা দৌঁড়াতে হতো না। পর্যায়ক্রমে ইনজিওগ্রাম ও ওপেনহার্ট সার্জারির মত জটিল অপারেশনও এ হাসপাতালে করা সম্ভব হতো। এভাবে যশোরবাসীকে বঞ্চিত করে পরবর্তীতে খুলনাতে চাচার নামে বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করেন শেখ হাসিনা।

যশোর শুধু প্রাচীনতম জেলা নয়, খুলনা বিভাগের কেন্দ্রে অবস্থান। বিভাগের সব জেলার সাথে যশোরের দূরত্ব কম ও যোগাযোগ সহজতর। এ বিবেচনায় হৃদরোগের সর্বাধুনিক চিকিৎসা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে যশোরে স্থপিত হয় যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিট(সিসিইউ)। এটি ছিল খুলনা বিভাগের প্রথম বিশেষায়িত হাসপাতাল। হৃদরোগে আক্রান্তদের উন্নত চিকিৎসা এনজিওগ্রামসহ নানা সুযোগ সুবিধা রাখা হয় হাসপাতালটিতে।

এ হাসপাতালটির স্থাপনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর যশোরে আসেন বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এদিন তিনি যশোর ১০০ শয্যা বিশিষ্ট যশোর জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত করেন এবং ওই দিন হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন। ওই অনুষ্ঠানে ২৮ শয্যা বিশিষ্ট বিশেষায়িত কার্ডিয়াক হাসপাতালের দাবি করেন যশোর উন্নয়নের বাতিঘর প্রয়াত তরিকুল ইসলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে দাবি মেনে নিয়ে বিশেষায়িত হাসপাতালের ঘোষণা দেন।

২০০৫ সালে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ২৮ শয্যা বিশিষ্ট করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)। সরকারি টাকা ছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় তরিকুল ইসলাম ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘হাসান এন্ড সন্স’ কে কাজ শুরু করার অনুরোধ করেন। তরিকুল ইসলামের অনুরোধে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মাত্র ১০ মাসে তৃতীয়তলা বিশিষ্ট সিসিইউ ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করতে আরো দুই মাস সময় লেগে যায়। সবমিলে ১২ মাসে হাসপাতালের বাহ্যিক অববয় সম্পূর্ণ হয়। প্রকল্প অনুযায়ী ওই সময় দক্ষিণাঞ্চলে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও অত্যাধুনিক হাসপাতাল ভবন ছিল যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিট।

এরপর ২০০৬ সালের ১২ অক্টোবর তরিকুল ইসলাম সিসিইউ ভবনের উদ্বোধন করেন। তখন তিনি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। উদ্বোধনের প্রাক্কালে সিসিইউ  পেয়েছিল বিশ^মানের একটি হাসপাতালের রূপ। হাসপাতালটির চিকিৎসা কার্যক্রম বেগবান করতে ২০০৭ সালে বরাদ্দ হয় ১শ ৬টি অত্যাধুনিক চিকিৎসা উপকরণ।  উপকরণের মধ্যে ছিল ১টি ইটিটি মেশিন, ১টি ইকোমেশিন, ১টি সিআর্ম মেশিন, ৪টি ৩ চ্যানেলের ইসিজি মেশিন, ১০টি ডিফিব্রিলেটর কার্ডিয়াক মনিটর, ৪টি ভেন্টিলেটর, ১টি রেফ্রিজারেটর, ২৫টি ইনফিউশন পাম্প সেট, নিউরোমাসকুলার ব্লক মনিটর, ব্লাড ভার্নিং ডিভাইস, ৬টি পালস অক্সিমিটার, ২টি কার্ডিয়াক মনিটর, ২০টি নেবুলাইজার মেশিন। ১৫ কোটি টাকার এ সকল যন্ত্রপাতি কোন দিন ব্যবহৃত হয়নি। কেননা এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য চিকিৎসক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে যেতে পারেনি বিএনপি সরকার।

এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ২০০৯ সালে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিসিইউ নিয়ে শুরু হয় রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাসান আল মামুনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি ওই করোনারি কেয়ার ইউনিট দ্বিতীয় বার উদ্বোধন করেন। কিন্তু বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিবর্তে এটি ব্যবহার হতে থাকে নানা কাজে। উন্নত যন্ত্রপাতিগুলো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থেকে সব নষ্ট হয়ে যায়। ওই সব যন্ত্রপাতির এখন আর হদিসও নেই। হাসপাতালের শোভাবর্ধনে লাইটপোস্টও নেই।

প্রথমে সিসিইউ ভবনের নিচতলা বহির্বিভাগের চেম্বার, দ্বিতীয়তলা যশোর মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের চেম্বার, শিক্ষক সমিতির অফিস, বিশ্রাম রুম, চায়ের স্টল করা হয়। মেডিকেল কলেজ নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হলে নিচতলায় বর্হিবিভাগ, দ্বিতীয়তলা চিকিৎসকদের কক্ষ, তৃতীয়তলায় কাডিয়ার্ক ওয়ার্ড করা হয়। সম্প্রতি চতুর্থ তলার সম্প্রসারণকরে নির্মাণ করা হয়েছে আইসিইউ। যা এখনো চালু হয়নি। এভাবে ভবনের রূপান্তর ঘটিয়ে সিসিইউ ভবনের প্রকৃত রূপ পাল্টে দেওয়া হয়েছে। যেখানে রোগীদের পাওয়ার কথা ছিল বিশ্বমানের কার্ডিয়াক চিকিৎসা সেখানে তারা পাচ্ছে হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসা। এখানে নেই কোন যন্ত্রপাতি। আনুসাঙ্গিক সুবিধা।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কোপানলে পড়ে যশোর করোনারি কেয়ার ইউনিটের যেমন মৃত্যু হয়েছে, তেমনি বৃহত্তর যশোরের মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তরিকুল ইসলামের উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার এ কাজ করেছে।

এ ব্যাপারে যশোর মেডিকেল কলেজের কার্ডিয়াক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শওকত আলী ও সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. খন্দকার রফিকুজ্জামান বলেন, সিসিইউ ভবনে কার্ডিয়াক রোগীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পাবেন এটাই হওয়া উচিৎ। সে জন্য সকল সুবিধা থাকবে- এটি তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু এসব সুবিধা নেই। ফলে রোগীদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা এবং নিজেদের মেধা খাটিয়ে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে পরিবেশ নেই। সিসিইউ ভবন ৩টি অংশে ভাগ করে অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা একটি সুন্দর হাসপাতালের বহুমাত্রিক রূপান্তর ঘটনা হয়েছে। এক কথায় একটি বিশেষায়িত হাসপাতালের মৃত্যু হয়েছে।