এবছরও খনন হল না পানি নিষ্কাশনের খালটি, বৃষ্টিতে সেই দুর্ভোগ যশোরে

0

আকরামুজ্জামান ॥ এবছরও একই চিত্র। পানি নিষ্কাশনের খালটি না হয়েছে সংস্কার, না হয়েছে পাকা। ফলে বৃষ্টিতে এবছরও দুর্ভোগ যশোর পৌরবাসীর। সামান্য বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে শহরের অলিগলি। গতকাল সকাল থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে যশোর শহরে। রেকর্ড ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে। শহরের নিম্নাঞ্চল দূরের কথা এমন কোনো সড়ক ছিলো না যেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়নি।
দুপুরের দিকে মাত্র দুই ঘন্টার বৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে হাটু পানি জমে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ছোট-বড় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হতে হয় শহরের খড়কী ও শংকরপুর এলাকাবাসীর। এসব এলাকায় সড়কের ওপর পানি উঠে যাওয়ায় কোনটি সড়ক ও কোনটি ড্রেন তা বোঝা দায় হয়ে পড়ে। এসব এলাকার সড়ক দিয়ে চলাচলের সময় রিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহনের চাকা পানিতে তলিয়ে যায়। সড়কের আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের বাড়িতেও ময়লা পানি ঢুকে পড়ে।
পৌর নাগরিকরা জানান, দেশের সর্বপ্রাচীন জেলা শহর যশোরের এ করুণদশা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ পরিস্থিতি চলে আসলেও তার সমাধান হচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনের জন্য কোটি কোটি টাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করার পরও এর সুফল মিলছে না। বরং অভিযোগ রয়েছে অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও সময়মতো ড্রেনের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার না করার কারণে এ পরিস্থিতি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তাই দ্রুত এ জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পৌর নাগরিকরা।
নাগরিকদের অভিযোগ, যশোর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পানি শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা জনকল্যাণে কোনো কাজে আসছে না। এটি কার্যত অকার্যকর ও অপরিকল্পিতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যশোর শহরের ভেতর দিয়ে ভৈরব ও মুক্তেশ্বরী নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে ভৈরব নদ দিয়ে শহরের উত্তরাংশ ও মুক্তেশ্বরী নদী দিয়ে শহরের দক্ষিণাংশের পানি নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু পৌরসভা নির্মিত পয়ঃনিষ্কাশন নালা (ড্রেন), রেলের তিনটি কালভার্ট ও শহরের গাজীর বাজার-চাঁচড়াগামী সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল ভরাট ও বেদখল হওয়ায় পানি মুক্তেশ্বরী নদীতে যেতে পারছে না। তাছাড়া শহরের যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আছে তা কার্যত ময়লা-আবর্জনার কারণে অচল হয়ে আছে। এতে বৃষ্টি হলেই মুহূর্তে জ¦লাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে গোটা শহরে। যা শনিবার প্রকট আকার ধারণ করে।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানাগেছে, শনিবার সকাল ৬ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত যশোরে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এরমধ্যে দুপুর ১ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত মাত্র দুই ঘন্টায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। এটি চলতি বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলে আবহাওয়া অফিস বলেছে। মাত্র দুই ঘন্টার এই বৃষ্টিতে নাকাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যশোর শহরবাসীকে।
শহরের হরিনাদত্ত রোড, কারবালা রোড, বেজপাড়া আনসার ক্যাম্প রোড, ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন) রোড, কারবালা সড়ক, শাহ আব্দুল করিম রোড, সার্কিট হাউস সংলগ্ন রোড, বেজপাড়া আনসার ক্যাম্প রোড, শংকরপুর আশ্রম রোড, রেলবাজার রোড, চোপদারপাড়া রোড, বকচর হুশতলাসহ অন্তত ৭০টি সড়কে হাটুপানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে শহরের খড়কি এলাকায় করুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওই এলাকার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে শহর থেকে। বিশেষ করে শাহ আব্দুল করিম সড়কের রুপকথার মোড় হতে পিরবাড়ি মোড় কবরস্থান পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকে। এর বাইরে খড়কি কবরস্থান মোড় পার হয়ে বামনপাড়া হয়ে ঢাকা রোড সংলগ্ন ফারুক রোড এলাকা পর্যন্ত সড়কের ওপর দুই থেকে তিন হাত পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি। এসব এলাকার সড়কগুলোতে গত কয়েকদিনে বৃষ্টিতে বিটুমিন ও ইট, খোয়া উঠে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি এমনিতে দুর্ভোগে ছিলো সাধারন মানুষ।
খড়কি এলাকার বাসিন্দা আলিমুজ্জামান বলেন, খড়কি এলাকায় এমনিতে শহরের অন্যান্য এলাকার চেয়ে নিচু। এখানকার যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আছে তা দিয়ে এমনিতে শহরের অন্যান্য এলাকার পয়োনিষ্কাশনের নালা দিয়ে পানি আসে। ওই পানি আর বের হতে পারেনা। আবার যেসব কালভার্ট আছে তা ভরাট হয়ে আছে। এজন্য সামান্য বৃষ্টি হলেই এখানকার মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েন। তবে শনিবারের বৃষ্টিতে ওই এলাকার বাসাবাড়িতে রাস্তার পানি ঢুকে পড়েছে বলে তিনি জানান।
একই এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলের মানুষ বর্ষা মৌসুমে দুর্ভোগে পড়ে আসছেন। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়না। সম্প্রতি এ বিষয়ে মেয়রের সাথে দেখা করতে গেলেও তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, এমনিতে রাস্তার বিটুমিনের আস্তরণ রাস্তায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। তাপর হাটপানি। এ অবস্থায় কোনোপ্রকার এ রাস্তা দিয়ে চলাচলের কোনো সুযোগ নেই।
রাজিয়া সুলতানা নামে এক বাসিন্দা বলেন, শাহ আব্দুল করিম রোড সংলগ্ন যশোরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ সরকারি এমএম কলেজ। অথচ এই সড়কের বিষয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই পৌর কর্তৃপক্ষের। দুপুরের পর থেকে বাসা থেকে বের হতে পারছেন না বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, খড়কি এলাকার শত শত শিক্ষার্থী আজ বাসা থেকে বের হতে পারেননি। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এ বিষয়ে যশোর পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী কামাল হোসেন বলেন, শনিবার যশোরে যে বৃষ্টি হয়েছে তা পর্যাপ্ত ছিলো। মাত্র দুই ঘন্টায় ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে কিছু সময়ের জন্য সড়কে পানি জমা স্বাভাবিক। তবে খড়কি এলাকার বিষয়টি আলাদা। এজন্য আমরা শহরের নিম্নাঞ্চল চিহ্নিত করে পানি নিষ্কাশন ও সড়ক নির্মাণ দুই কাজের উদ্যোগ নিয়েছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেনেজ নির্মাণের কাজে হাত দেয়া হবে। তবে রেলওয়ের জায়গার স্থাপনা নিয়ে কিছু কিছু এলাকায় সমস্যা আছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে যশোর পৌরসভার মেয়রের কাছে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় সম্ভব হয়নি।
তবে পৌরসভার প্যানেল মেয়র মোকসিমুল বারী অপু বলেন, যশোর শহর থেকে দুটি পথে পানি নিষ্কাশন হয়। এর একটি অংশের পানি ভৈর নদে পড়ে আর অপরটি হরিনার বিলে গিয়ে পড়ে। কিন্তু হরিনা বিল সংলগ্ন মেডিকেল কলেজ নির্মাণ হওয়ার পাশাপাশি বড় বড় স্থাপনা তৈরী হওয়ায় ওই অংশে পানি ঢুকতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে খড়কিসহ ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা প্রকট হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের প্রকৌশলীরা গবেষণা করে দেখেছেন এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণে এ অংশের পানি মুক্তেশ্বরী নদীতে ফেলতে হবে। এক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটার একটি খাল খনন জরুরি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এনজিএসপি নামে একটি প্রকল্পের সাথে আমাদের চুক্তি হচ্ছে। তারা খাল খননের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করবে। তবে সেটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া বলে তিনি দাবি করেন।