লোকসমাজ ডেস্ক॥ এবারের বাজেট কার্যকর হওয়ার পর মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কর ব্যবস্থায় ধনীরা বেশি কর দেবেন, মধ্য ও নিম্ন আয়ের কর দেবেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী-বাজেটে এধরনের কোনও বিধান রাখা হয়নি। বরং নতুন বাজেটে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খরচের ওপর নতুন করে নানা রকম করারোপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
গতপরশু বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে বাজেট উপস্থাপন করেন, তাতে মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে খরচও বাড়বে। শুক্রবার রাত ১২টা থেকেই কার্যকর হয়েছে নতুন কলরেট। যদিও মোবাইল ফোন এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং জরুরি প্রয়োজন। সব শ্রেণির মানুষই এর ব্যবহারকারী এটা অর্থমন্ত্রী ভালো করেই জানেন।
শুধু মোবাইল ফোন নয়, আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের অতি প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি সাধারণ মানুষের মেট্রোরেলের ভাড়ায় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) মওকুফের ঘোষণা দেননি। ফলে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন না হলে পরের দিন অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে মেট্রোরেলে চড়তে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে যাত্রীদের। সবচেয়ে বড় কথা অর্থনীতির এমন দুঃসময়ে অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করলেন, তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য স্বস্তির খবর কম। উল্টো করারোপের চাপ। যদিও অতি ধনীদের ওপর আলাদা করে বাড়তি কোনও বোঝা চাপেনি।
অবশ্য ধান, চাল, গম, আটা, ময়দাসহ নিত্যপণের ওপর উৎসে কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার কারণে মধ্যবিত্তের জন্য খানিকটা স্বস্তি হয়তো আসবে, কিন্তু অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে ঠিকই বাড়বে করের চাপ। ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম কমাবেও কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
সরকার এবার করের সর্বোচ্চ হার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিন মনে করেন নতুন করে করারোপ ও করছাড়ের বিবেচনায় এটা মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়ানোর বাজেট।
সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত চাপে পড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমদানি শুল্ক কমানোর কথা বলা হলেও তাতে খুব বেশি কাজ হবে না। আর ২০ শতাংশ থেকে ১ বছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’। ১৭৪ পৃষ্ঠার বক্তব্যে তিনি ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নানা আশার কথা শুনিয়েছেন। তবে সমৃদ্ধ হতে গেলে তো অর্থনীতির এখনকার সংকট আগে সামাল দিতে হবে। সেই জায়গায় তার বক্তব্যের পৃষ্ঠা বরাদ্দ ছিল একেবারেই কম।
‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শীর্ষক নতুন বাজেটে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন কোনও সংস্কারের কথা বলেননি অর্থমন্ত্রী। যারা কর ফাঁকি দেন, তাদের ওপর চাপ বাড়ানোর কোনও কথাই নেই বাজেটে। বরং যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের কাছ থেকেই বাড়তি কর আদায়ের ছক কষেছেন অর্থমন্ত্রী।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) দিকেই অর্থমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর মানে এর বোঝা সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। অথচ আয়করে কোনও ছাড় পাননি তারা। যদিও ধনীদের বেলায় কিছুটা নমনীয় অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ ধনীদের ওপর কোনও বাড়তি বোঝা আসেনি।
যেমন, সারচার্জমুক্ত সম্পদের সীমা ৪ কোটি টাকাই রয়ে গেছে, কোনও করহারেই কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি। বিলাসবহুল পণ্যের ক্ষেত্রে যানবাহনের কার্বন করেও কোনও পরিবর্তন আনা হয়নি।
সারচার্জের বিদ্যমান কাঠামো অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেট প্রস্তাবে। আগের মতোই ধনীদের ৩ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পদ, অথবা একাধিক গাড়ি, অথবা নগর অঞ্চলে ৮ হাজার বর্গফুটের বেশি আবাসন থাকলে ১০ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে। ১০ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির জন্য ২০ শতাংশ এবং ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার সম্পদের জন্য ৩৫ শতাংশ সারচার্জ দিতে হবে। এছাড়া বিলাসবহুল আরেক ক্ষেত্র ভ্রমণ করেও হাত দেওয়া হয়নি।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ, সবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, এলডিসি থেকে উত্তরণ, ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজ করা, বিনিয়োগ ও শিল্পের প্রসার, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা বিশেষ অগ্রাধিকার পেয়েছে। নতুন অর্থবছরে অনেক আশার কথা শুনিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। যদিও স্বীকার করে নিয়েছেন, বিগত দুটি বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেও তা অনমনীয়ভাবে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে। এ জন্য নতুন অর্থবছরে আগে নেওয়া দুই নীতিই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যেমন বাজেট–ঘাটতি কমানো এবং কৃচ্ছ্রসাধন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে অন্তত ২৭টি প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পিঁয়াজ, আটা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনিসহ ৩০ ধরনের নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ককর কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
একইসঙ্গে অন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিরোধিতা সত্ত্বেও খাদ্য ও কৃষিসহ অন্যান্যা প্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও চড়া মূল্যস্ফীতির বাজারে এবারও ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছর থেকে বহাল থাকা বিভিন্ন শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা সংকুচিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার্থে করপোরেট কর হার শর্তসাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রতি বছর নতুন নতুন করদাতার অনুসন্ধানের ঘোষণার মতো এবারও একই রকম ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এর বিস্তারিত কোনও পরিকল্পনা তিনি তুলে ধরেননি। বরং কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ব্যাপারে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপরই করের বোঝা চাপাবে।
শুধু তাই নয়, অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন পদক্ষেপে চাপে পড়তে পারে রফতানি খাত। বিশেষ করে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত নিয়ে অর্থমন্ত্রীর একাধিক প্রস্তাব শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতায় নতুন দুর্বলতা তৈরি করতে পারে। বাজেট প্রস্তাবে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা থাকা রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের পণ্য তৈরিতে আমদানি করা কাঁচামালে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে। এত দিন শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করা যেত। শিল্পের মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে গড়ে ১ থেকে দেড় শতাংশ শুল্ক ছিল, যা বাজেটে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রি-ফ্র্যাব্রিকেটেড ভবন নির্মাণে আমদানি করা উপকরণে শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে। বাজেটে এ রকম আরও কিছু প্রস্তাব রফতানি পণ্যের উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।
এদিকে শেয়ার বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াবে, এমন কোনও পদক্ষেপ আসেনি নতুন বাজেটে। উল্টো কর বাড়ানো হয়েছে। শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কর বসানো হয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব বিনিয়োগকারী বছরে শেয়ারবাজার থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন, তাদের অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। অর্থাৎ কোনও বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বেচাকেনা করে ৫১ লাখ টাকা আয় করলে তাকে ১৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে এই হারে কর বাড়তে থাকবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে টানা চার বছর পর ১৫ শতাংশ জরিমানা হিসেবে আবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আনা হয়েছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে থাকা কালো টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে আসবে। যা চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।