ওএমএসের কার্ড করতে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ করছেন ডিলাররা

0

মাসুদ রানা বাবু॥ যশোরে ওএমএস কার্ড বিতরণ কার্যক্রমে ডিলারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত ডিলাররা নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের কার্ড পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যে কারণে দুঃস্থ, অসচ্ছল এমনকি প্রতিবন্ধী ও পঙ্গু ব্যক্তিরা পর্যন্ত কার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক জেলা সদরে পাঁচজন ডিলারকে এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ৩৫০ জন ভোক্তাকে কার্ড প্রদান করা হবে। সে লক্ষ্যে ছয়জন ডিলারকে ভোক্তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং ছবি সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে। খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তালিকায় পাঁচজন ডিলারের নাম উল্লেখ রয়েছে। তারা হলেন যশোর পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ববারান্দিপাড়ার শেখ আবুল কাশেম বাবু, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের রবিউল ইসলাম, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে বোরহান শাহ সড়কের রোকন ব্যাপারী ও মুজিব সড়কের লাইজু জামান, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রেল রোডের তোতা মিয়া এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের গোলাম মোস্তফা। কিন্তু ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মুজিব সড়কের লাইজু জামানও নিজেকে এই কার্যক্রমের অর্ন্তভুক্তি দাবি করে তথ্য সংগ্রহ করছেন। খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের তালিকায় তার নাম নেই। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা নিত্যানন্দ কুন্ডু বলছেন, মোট ছয়জন ডিলারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ওএমএস কমিটির সভার মাধ্যমে। পরে একজনকে বাদ দেয়া হবে।
এদিকে কার্ড প্রদান লক্ষ্যে ৭ জুন থেকে ১৩ জুনের মধ্যে ভোক্তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও ছবি সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হয়। পাঁচ দিনের মধ্যে প্রত্যেক ডিলার দিনপ্রতি ২১৪ জন করে মোট ১০৭০ জন ভোক্তার জাতীয় পরিচয়পত্রে ফটোকপি ও ছবি জমা নিতে পারবেন। সকাল ৯ টা থেকে বিক্রয় কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ভোক্তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও ছবি জমা নেয়ার কথা। কিন্তু প্রথম দিন থেকে ডিলারদের বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে তা জমা দিতে পারছেন না ভোক্তারা। ডিলাররা খাতা কলমে তাদের পরিবারবর্গ,আত্মীয় -স্বজন, পছন্দের ব্যক্তি ও সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে জানিয়ে দিচ্ছেন তালিকা পূর্ণ হয়ে গেছে আজ আর জমা নেয়া হবে না। পাঁচ বিক্রয় দিবসে এভাবে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার কারণে প্রকৃত দুঃস্থ, অসহায় ভোক্তারা বঞ্চিত হয়েছেন। তারা ভোরের আলো ফোটার আগে থেকে জ্যৈষ্ঠের খরতাপের মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে কেবল দাঁড়িয়ে থেকেছেন। এভাবে পাঁচ দিন ধরে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও ছবি জমা না দিতে পেরে মনোক্ষুন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। পাঁচ বিক্রয় দিবসের মধ্যে পাঁচদিনই তারা বঞ্চিত হয়েছেন ডিলারদের স্বজনপ্রীতির কারণে।
এদিকে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ভোক্তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র ও ছবি জমা নেওয়ার সময় তাদের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু অধিকাংশ বিক্রয় কেন্দ্রে ওই প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকেননি। মঙ্গলবার (১৩ জুন) এই প্রতিবেদক সরেজমিন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিলারদের বিক্রয় কেন্দ্রে গেলে কেবল মাত্র একটি বিক্রয় কেন্দ্রে একজন প্রতিনিধির উপস্থিতি চোখে পড়ে। পূর্ববারান্দিপাড়ার ওএমএস ডিলার শেখ আবুল কাশেম বাবুর বিক্রয় কেন্দ্রে দেখা যায় তিনি প্রতিদিনের ন্যায় আটা বিক্রি করছেন। পাশের একটি মাঠে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি জমা নেওয়ার নাটক সাজিয়ে নাম মাত্র ভোক্তাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। এসময় সংবাদপত্র পরিচয় পাওয়া মাত্রই ক্ষুব্ধ ভোক্তারা এই প্রতিবেদক কে ঘিরে ধরেন। এসময় ৬৭ বছরের বয়সী রিকশাচালক রশিদ শেখ বলেন,গত পাঁচ দিন ধরে ছবি ও আইডি কার্ডের ফটো কপি নিয়ে কেবল লাইনে দাঁিড়য়ে থেকে বাড়ি যাচ্ছি। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলছে আজ আর জমা নেওয়া হবে না। এই অবস্থায় দেখতে দেখতে চার দিন কেটেছে যে কারণে আজ আর লাইনে দাঁড়াই নি। প্রতবন্ধী আনোয়ার হোসেন বলেন,আমি লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি ফিরে গেছি। আমার কষ্ট কেউ দেখে না। ষাটোর্দ্ধ মনোয়ারা বেগম বলেন,অন্যের বাড়ি থেকে ধোয়া মুছার কাজ করে বেঁচে আছি তাই ওএমএসের কার্ড পাবার আশায় গত কয়েক দিন ধরে এখানে আসছি কিন্তু আমরাটা জমা নেয়নি। একই কথা বলেন, আরজিন বেগম, নিলুফা ইয়াসমিন। তারা আরও জানান অনেক পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা গত কয়েক দিনে আমাদের মত কাগজ জমা দিতে না পেরে বাড়ি ফিরে গেছেন। এর আগে মুজিব সড়কের পাশে লাইজু জামানের বিক্রয় কেন্দ্রে যাওয়া মাত্রই ভোক্তারা একই অবস্থা সৃষ্টি করেন। এসময় মিজানুর নামের এক রিকশাচালক ছবি ও জাতীয় পরিচয় পত্রে ফটোকপি জমা দিতে না পেরে ছিড়ে ফেলেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাব,তাও ভালো। ঠিক একই ভাবে ষাটোর্দ্ধ নমিতা রানী,পারুল বেগম,মরিয়ম খাতুনও গত কয়েকদিন ধরে লাইন দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি বলেন। এসময় ডিলার লাইজু জামান ও তার স্বামী সংবাদ সংগ্রহের সময় এই প্রতিবেদকসহ ফটো সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোরা কি নিউজ করবি ? পজিটিভ নিউজ করবি,নেগেটিভ কোন কিছু লিখিস না যেন। এ কথা বলে ভোক্তাদের শাসিয়ে বলেন,ওরা দুই জন তোদের কার্ড করে দেবে, ওদের কাছে যা।
এদিকে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে গেলে জানা যায়,তিনি দাপ্তরিক কাজে জেলা বাইরে আছেন। পরে তিনি মুঠোফোনে বলেন,যা কিছু হচ্ছে নিয়মের মধ্যে হচ্ছে। ভোক্তাদের অভিযোগ সঠিক নয়। প্রতিদিন যে কয়েক জনের জাতীয় পরিচয় পত্র ও ছবি জমা নেওয়ার কথা ডিলার সেই কয়জনের তা জমা নিচ্ছেন।