বিদ্যুৎ : ৯টা-৩টা বা হোম অফিসের চিন্তা, এসি ২৫ ডিগ্রির নিচে না

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে। এর অভিঘাত এসে পড়েছে বাংলাদেশেও। জ্বালানির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে সরকার রেশনিং করছে। এই পরিস্থিতি আগামী সেপ্টেম্বরের আগে শেষ হচ্ছে না। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত এসেছে সরকারের তরফ থেকে। তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ-সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন।
যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে দেশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি সংকট থাকতে পারে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ ঘাটতি আছে ২০০০ মেগাওয়াটের মতো। জ্বালানি সাশ্রয় করা গেলে এটি ৫০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা সম্ভব।’
তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, পিক আওয়ারে ২০০০ মেগাওয়াট চাহিদা কমানো গেলে লোডশেডিংয়ের চাপ নাও থাকতে পারে। গ্রাম ও শহরে লোডশেডিং বণ্টনে ন্যায্যতা আনা কঠিন। গ্রামের মানুষকে বেশি ভুগতে হবে বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমাতে অফিস সময়ও কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। আবারও চালু হতে পারে হোম অফিস। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে জ্বালানি সাশ্রয়ের আহ্বান জানান তিনি।
তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আলোচনা করেছি। এটা হয়তো সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিবেচনাতেও আসতে পারে। আমরা কভিডের সময় আমাদের জীবনটাকে অন্যভাবে করেছিলাম। আপনারা জানেন যে কভিডের সময় কিন্তু উৎপাদনও হয়েছে, ব্যাহত হয়নি। তাহলে আমরা যদি আবার অফিস টাইম সংশোধন বা কিছু কমিয়ে আনতে পারি। পিক আওয়ারের আগে যেমন কভিডের সময় ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এটা ৯টা থেকে ৩টা করা যায় কিনা বা এক-দুই দিন ঘরে বসে কাজ করতে পারি কিনা; এটা করলে আমাদের চাহিদাটা কমবে, উৎপাদনশীলতা বজায় থাকবে। করোনাও বাড়ছে, সব দিক দিয়ে আমাদের সুবিধা হবে। এতে আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে।’
জাপান, ব্রিটেন ও জার্মানিতে লোডশেডিংয়ের উদাহরণ দেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে এমন অভিঘাত। আমরা সে তুলনায় ভালো আছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আজ আলোচনা করেছি। নিজেদের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি। আলোচনা করেছি কীভাবে আমরা সাশ্রয়ী হতে পারি। আমরা যে এসি ব্যবহার করি এর তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির নিচে হবে না। বিভিন্ন জায়গায় বিয়ে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে আলোকসজ্জা হয়, এগুলো করা যাবে না। বিয়ের অনুষ্ঠান বা অন্য অনুষ্ঠান যেগুলো রাতে হয়, সেগুলোকে আমরা আলোচনা করেছি যে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে সীমাবদ্ধ করার বিষয়ে।’
বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতির কারণে যেসব এলাকায় লোডশেডিং হবে, তার তথ্য আগে থেকে গ্রাহকদের জানিয়ে দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে পর্যালোচনা সভায়। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘যেসব জায়গায় যখন লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে আমরা আলোচনা করেছি যে, কীভাবে আগে জানানো যায়। এতে মানুষের একটা প্রস্তুতির সুযোগ থাকে। আমরা আগেও এটা করেছি। ফিল্ড লেভেলে আমাদের কয়েকটি কমিটি আছে। তারাই এ বিষয়টিকে বাস্তবায়ন করে। মূল দায়িত্বটা পড়ে ডিস্ট্রিবিউটিং কোম্পানিগুলোর ওপর। আমরা এই ব্যবস্থাটা রিভাইভ করছি। এখন তো এসএমএস করে জানানো যায়।’
তিনি বলেন, ‘ডিপিডিসি একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। এতে গেলে জানা যায় যে, লোডশেডিং হবে কি হবে না বা কখন হবে। এটাই আমরা অন্য কোম্পানিগুলোকে বলব যাতে তারা এটা গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয়ভাবে আমাদের যে মনিটরিং আছে সেটাকে আরও শক্তিশালী করা হবে, তদারকি বাড়ানো হবে।’
বিলখেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধেও কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দেন জ্বালানি উপদেষ্টা।
বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম : প্রতি বছর ৫৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর মধ্যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের পরিমাণ ১৫ লাখ টন। দেশের একমাত্র তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি এই তেল পরিশোধন করে। বাকি ৪০ লাখ টনের মধ্যে প্রায় ৩৬ লাখ টন পরিশোধিত তেল আমদানি করে বিপিসি। পেট্রোল ও অকটেন দেশের গ্যাস খনি থেকে পাওয়া উপজাত বা কনডেনসেট রিফাইন করে আসে। পেট্রোল ও অকটেন আমদানি করতে হয় না। মূলত আমদানি করা তেলের বড় অংশই ডিজেল।
বিপিসির দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৭৫ থেকে ৮০ ডলারের মধ্যে থাকলে না লাভ, না ক্ষতির মধ্যে থাকে। অর্থাৎ ৭৫ থেকে ৮০ ডলার প্রতি ব্যারেল তেল আমদানিতে খরচ হলে বিপিসির লাভও হয় না, লোকসানও হয় না। গতকাল প্রতি ব্যারেল ব্রিটিশ ব্যারেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ১০০ ডলারে।

জিপি মর্গানের বরাতে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গ দাবি করেছে যে, অপরিশোধিত তেলের দাম ১৯০ ডলারে গিয়ে পৌঁছতে পারে। এমনকি তা ৩৮০ ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
জ্বালানি তেলের এমন মূল্য পরিস্থিতি উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েক দিন ধরেই লক্ষ করছি প্রায় ৬-৭ মাস যাবৎ তেলের মূল্য ঊর্ধ্বগতি প্রচণ্ডভাবে। যে তেল আমরা ৭০-৭১ ডলারে কিনতাম এখন বহু বেড়ে গেছে। সেটা সবসময় বাড়তির দিকেই যাচ্ছে। আমরা বলে আসছি প্রথম থেকেই তেলের দামের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের দিকে যাব। কিন্তু আমরা নিজস্ব অর্থে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় একটা সময় গিয়ে আমাদের মূল্য সমন্বয়ের দিকে যেতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সারা বিশ্বে তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ তারা নিয়েছে। তেলের মূল্য তারা সমন্বয় করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই বলি, তাদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ টাকা পার্থক্য লিটারপ্রতি বিভিন্ন তেলের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ৬৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র গ্যাস দিয়ে চলে। আমাদের যে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস, আমরা দিন দিন বাড়াচ্ছি, আবার দিন দিন গ্যাস কমছে এ দুটো দিকই আছে। যেটা আমরা বাড়াচ্ছি, যে খনিগুলো থেকে গ্যাস পাচ্ছি, সেটা খুব স্বল্প পরিমাণে। কিন্তু কমছে খুব দ্রুতগতিতে। আমি পাঁচ বছর আগে থেকে বলে আসছি আস্তে আস্তে গ্যাস কমতির দিকে যাবে।’
নসরুল হামিদ বলেন, ‘গ্যাসের যে ঘাটতি ছিল সেটা আমরা আমদানি করা গ্যাস দিয়ে পূরণ করতাম। এর মধ্যে আমাদের দুটি ধারা একটি হলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, সে ক্ষেত্রে দামটা নির্ধারিত। তুলনামূলক এই দামটা তেলের সঙ্গে ওঠানামা করে। আরেকটা হলো স্পট মার্কেট। এই মার্কেটে এখন চাহিদা খুব বেড়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।’
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ইউরোপের অধিকাংশ দেশ গ্যাস নেয় রাশিয়া থেকে। সেটা তারা এখন বন্ধ করে দিচ্ছে বলেই সব দেশ গ্যাসের জন্য স্পট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। এ কারণে যে গ্যাসের দাম ছিল ৪ ডলার তা বেড়ে হয়ে গেছে ৩০ ডলার। সেটা কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অর্থের জোগান দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সরকারি ভর্তুকি দিয়েও এই পরিমাণ অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি জ্বালানির দাম শুধু বাড়াতেই থাকি তাহলে সাধারণ মানুষের ওপর প্রচণ্ডভাবে চাপ তৈরি হবে। আমি আগে থেকেই বলে আসছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কিছু করবেন না যাতে সাধারণ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যায়। যার কারণে আমরা গ্যাসে সামান্য পরিমাণ মূল্য সংযোজন করেছি। এখনো আমরা তেলের ব্যাপারে করিনি। আমি আশা করব সবাই বিষয়টি বুঝতে পারবেন এবং ধৈর্য ধরবেন। এটা খুব সাময়িক। এটা খুব দীর্ঘকালের জন্য নয়। আমাদের প্রচুর বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। কিন্তু আমরা গ্যাসের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছি। আমরা সার উৎপাদন ও শিল্পকারখনায় বেশি গ্যাস দেওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।
নসরুল হামিদ বলেন, সবাই যদি গ্যাস ব্যবহারে একটু মিতব্যয়ী হয় তাহলে এটা অবশ্যই এ পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করা যাবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ভরসা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা এই বিপদমুক্ত হব।’

সূত্র : দেশ রূপান্তর