ভয়নগরে হ্যাচারি ছাড়াই বছরে হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন

0

 

নজরুল ইসলাম মল্লিক, অভয়নগর (যশোর) ॥ অভয়নগর উপজেলায় মৎস্য সেক্টর নানামুখি সমস্যায় জর্জরিত হলেও এরই মাঝে বছরে হাজার কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছসহ গলদা ও বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের বৃহৎ অঞ্চল অভয়নগর। উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মৎস্য চাষি সরাসরি মাছ উৎপাদনের সাথে জড়িত। যদিও এদের অধিকাংশের কোন কারিগরি প্রশিক্ষণ নেই। তাছাড়া যশোরের দুঃখখ্যাত ভবদহ অধ্যুষিত অভয়নগরের এক বৃহদাঞ্চল বছর জুড়েই জলাব্ধতায় নিমজ্জিত থাকে। কখনও কখনও এ জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ফলে মৎস্যচাষিদের কোটি কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়। এ কারণে অনেকে মৎস্য উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
বছরে কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হলেও অভয়নগরে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছের পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি নেই। ফলে পোনা কিনতে একদিকে যেমন চাষিদের মোটা অংকের টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে হতে হচ্ছে প্রতারিত। তথাপি এ অঞ্চলের মৎস্যচাষিরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে। চলতি বছরে এ উপজেলায় ৩০ হাজার মেট্্িরক টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশা প্রকাশ করেছেন, মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকে টপকে যেতে পারে। তবে সকল সমস্যার সমাধান করে মৎস্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা গেলে এ উপজেলায় মাছ উৎপাদন দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন এ কর্মকর্তা। অভয়নগর উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় চলতি বছরে ১৫ হাজার ২৭৫ জন মৎস্য চাষি রয়েছেন। এছাড়া নিবন্ধনকৃত জেলে রয়েছেন ১ হাজার ৫৪৮ জন এবং মৎস্যজীবী রয়েছেন ২ জাজার ৭০ জন। ১৫ হাজার ৭৩ হেক্টর জমিতে এবার মাছ মাছ চাষ হয়েছে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০ হাজার মেট্টিক টন।
উপজেলা মৎস্য অফিস দাবি করেছে, এবার মাছের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্র জানায়, উপজেলায় মাছের স্থানীয় চাহিদা রয়েছে প্রতিদিন জনপ্রতি ৬০ গ্রাম হিসেবে ৬০৭২ মেট্্িরক টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বছরে প্রায় ২৪ হাজার মেট্্িরক টন মাছ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যা দেশে মাছের চাহিদা মেটাতে এবং দেশীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র আরও জানায়, সাদা মাছের পাশাপাশি গলদা চিংড়ি উৎপাদনে অভয়নগর উপজেলা ঈর্ষন্বীয় অবদান রেখে চলেছে। এ উপজেলায় মোট ৭ হাজার ৭৬৯ হেক্টর আয়তনের ২০ হাজার ৬৫৫টি চিংড়ি ঘের রয়েছে। যার মধ্যে গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে ৭ হাজার ৫২৯ হেক্টর আয়তনের ২০ হাজার ৫শটি। যেখানে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মেট্্িরক টন গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয়। এছাড়া উপজেলায় মোট ২৪০ হেক্টর আয়তনের ১৫৫টি বাগদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। যেখানে প্রায় ১শ মেট্্িরক টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়ে থাকে। অন্যান্য চিংড়ি উৎপাদন হয় প্রায় ৩০ মেট্্িরক টন।
কেবল মাছের ঘেরেই নয়, এ উপজেলায় মোট ৩৪৫২.৫০ হেক্টর আয়তনের ৪ হাজার ৮১০টি পুকুরে বছরে ১৬৬৪২.৫৭ মেট্্িরক টন মাছ উৎপাদন হয়। মোট ৯৮ হেক্টর আয়তনের ২টি বাঁওড়ে ১৮০ মেট্্িরক টন মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। এছাড়া ভৈরব, টেকা ও শ্রীনদী হতে বছরে ৬৭ মেট্টিক টন, ৮৭৫ হেক্টর প্লাবন ভূমি থেকে বছরে ২৫৮ মেট্্িরক টন এবং বর্ষা প্লাবিত ২ হাজার ১৫০ হেক্টর ধান ক্ষেত থেকে আরও ৩ হাজার ১৫৩ মেট্্িরক টন মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। কেবল মাছ উৎপাদন নয় উপজেলায় মাছের পোনা উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছেন ৬৪ জন নার্সারার। যারা মোট ৩০৭.৮৪ হেক্টর আয়তনের ৬১১ টি নার্সারি পুকুরে বছরে ১২২৬.৭ লাখ পিস মাছের পোনা উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া ৭ টি হ্যাচারিতে বছরের ৪০০৬ কেজি রেনু উৎপাদন করা হয়। যদিও এ পোনা ও রেনু উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সীমিত। ফলে চাষিদের অধিক দামে বাইরে থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলায় ছোট বড় ৩০টি মাছের বাজারে এ মাছ কেনা-বেঁচা হয়ে থাকে। পাশাপাশি উপজেলায় ২টি চিংড়ির ডিপোও রয়েছে। তবে মৎস্যচাষিদের অভিযোগ, মৎস্য খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, মৎস্য ঘেরগুলোকে বাণিজ্যিক বিবেচনায় বিদ্যুৎ বিল নির্ধারণ, ভবদহ অঞ্চলের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা, চাষিদের কারিগরি জ্ঞানের অভাব, গলদার পোনার স্বল্পতা ও দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনার উৎপাদনের হ্যাচারি না থাকায় এ উপজেলায় অনেকে মৎস্য চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এসব সমস্যার সমাধান হলে উপজেলায় মৎস্য চাষ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করেন মৎস্যচাষিরা।
এ ব্যাপারে অভয়নগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হুসাইন সাগর বলেন, অভয়নগরে প্রতি বছর মাছের উৎপাদন বাড়ছে। মৎস্য অফিসের সহায়তায় মৎস্যচাষিরা মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। যদিও এই মুহুর্তে মৎস্য অফিসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা ও ক্ষেত্র সহকারীর পদ শূন্য থাকায় মৎস্য অফিসকে এ বৃহদাঞ্চলের মৎস্যচাষিদের পাশে দাঁড়াতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও আমরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি এ বছর মাছের উৎপাদন গত বছরের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে মাছ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে বেশ কিছু সুপারিশ উল্লেখ করেছেন এ কর্মকর্তা। সেগুলো হলো- খামার যান্ত্রিকীকরণের সুযোগ বৃদ্ধি করা, উন্নয়ন প্রকল্পের ঘাটতি হ্রাসকরণ, শূন্যপদে জনবল পদায়ন, মৎস্য ঘের/ খামারের ডাটাবেজ তৈরি, মাছ চাষে বিদ্যুতের মূল্য হ্রাস, মাছ রফতানির জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি, প্রতি ইউনিয়নে একজন ক্ষেত্র সহকারী নিয়োগ, আঞ্চলিক প্রকল্প গ্রহণ করে স্থানীয় চাহিদা মেটানো। এ সমস্যাগুলো দূর করে পরিকল্পিতভাবে মৎস্যচাষিদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে অভয়নগর উপজেলায় মাছের উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।