মুখ লুকিয়ে টিসিবি’র লাইনে

0

শামীমুল হক॥ টিসিবি’র পণ্য নিতে লম্বা লাইন। পুরুষের চেয়ে বোরকা পরিহিত নারীর সংখ্যাই বেশি। সকালে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মাঈদুল ইসলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনও এগুচ্ছে। এক পর্যায়ে মাঈদুল ট্রাক ছুঁতে পারলেন। এবার পণ্য নেয়ার পালা। কিন্তু তিনি বারবার মুখ লুকাচ্ছিলেন। এই মহল্লায়ই থাকেন। পরিচিত জন কেউ যদি দেখে ফেলেন-এ জন্যই মুখ লুকানোর চেষ্টা। তিনি ৮৬০ টাকা দিয়ে পাঁচ কেজি পিয়াজ, পাঁচ কেজি ছোলা, দুই কেজি সয়াবিন তেল, ডালসহ আরও কিছু পণ্য নিলেন। পণ্যের ব্যাগ হাতে নিয়েই লুকালেন পাশের ভবনের সিঁড়ির নিচে। জিজ্ঞেস করতেই চমকে উঠেন। বলেন, এ পণ্যগুলো কোনো দোকান থেকে কিনলে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ টাকা লাগতো। টিসিবি’র ট্রাক থেকে কেনায় ৪০০ টাকা লাভ হয়েছে। কিন্তু আমি টিসিবি’র লাইনে দাঁড়াবো কখনো কল্পনাও করিনি। গুলিস্তানের একটি মার্কেটে দোকান আছে। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনা আসার পর দিন দিন অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে পড়ে। বসে বসে পুঁজি খেয়ে শেষ করেছি। তিন সন্তানের সবাই লেখাপড়া করছে। তাদের স্কুল, কলেজের খরচ। বাসাভাড়া। চিকিৎসা ব্যয়। সারা মাসের খাবার খরচ। ব্যবসা থেকেই এসব খরচ চালাতাম। ভালোই চলছিল দিন। কিন্তু এখন সবই শেষ। দোকানে মাল নেই। সেভাবে ক্রেতাও আসে না। আয় একেবারে কমে গেছে। কিন্তু ব্যয়? সে তো একই রয়ে গেছে। বরং নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার খড়গ এসে জুড়েছে। ফলে অসহায় হয়ে পড়েছি। তাই উপায় না পেয়ে টিসিবি’র পণ্য নিতে লাইন ধরেছি। ৪০০ টাকা বাঁচানোর জন্য নিজের সম্মান বিকিয়ে দিলাম। অনেকেই হয়তো দেখেছে। কী করবো বলুন। দিন তো চালিয়ে নিতে হবে। সংসারের ঘানি যে ফুয়েল ছাড়া চলে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাঈদুল বললেন, আমার মতো এমন শত শত মাঈদুল এখন টিসিবি’র ট্রাকের দিকে চেয়ে থাকে। আমরা কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। সইতেও পারছি না। ক্ষুধার কষ্ট যে কি তা বলে বুঝানো যাবে না। সন্তানের মুখে যখন ক্ষুধার চিহ্ন দেখি তখন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারি না। মাঈদুল থাকেন কদমতলী থানার মদিনাবাগে। জনতাবাগ চৌরাস্তায় স্থানীয় কমিশনার আনোয়ার মজুমদারের তত্ত্বাবধানে এখানে প্রায় প্রতিদিনই টিসিবি’র ট্রাক নিয়মিত আসে। এলাকাবাসী এখান থেকে টিসিবি’র পণ্য কম দামে নিয়ে যায়।
রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডে রাস্তা পারাপারের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে বানানো হয়েছে ফুটওভারব্রিজ। এ ব্রিজই এখন রাহেলার আয়ের উৎস। প্রতিদিন রাত ৮টায় দুই সন্তানকে নিয়ে ব্রিজে আশ্রয় নেন। দুই হাত বাড়িয়ে দেন ব্রিজ পারাপারে রত মানুষের সামনে। ভাই আমি ভিক্ষুক নই। দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে আপনাদের সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। যদি সম্ভব হয়, ২/১টি টাকা দিয়ে যাবেন। সারা শরীর বোরকায় ঢাকা। চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। নাম জিজ্ঞেস করতেই বলেন, রাহেলা। মাতুয়াইলে থাকেন। স্বামী রতন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার সময় চাকরি চলে যায়। এরপর কোনো দিন রিকশা চালিয়ে, কোনো দিন দিনমজুরি করে যা আয় করতেন তা দিয়েই কোনোরকমে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে রিকশা এক্সিডেন্ট করে এখন বাসায় বসা। তিন দিন একনাগাড়ে না খেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে ফুটওভার ব্রিজে আশ্রয় নেন। দিনে এলে অনেকে চিনে ফেলতে পারে। তাই রাতে মুখ ঢেকে হাত পাতেন তিনি। রাহেলার কথা, জীবনে কখনো এভাবে হাত পাততে হবে ভাবিনি। এ ক’দিনে কষ্ট কী তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। পেট মাটিতে দিয়ে গড়াগড়ি খেয়েছি। নিরুপায় হয়ে এ রাস্তা বেছে নিয়েছি। স্বামীও আমার এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কাঁদছে। তাকে বুঝিয়েছি, সুস্থ হয়ে আবার রিকশার প্যাডেলে পা রেখো। আমি ফুটওভারব্রিজ ছেড়ে ঘরে চার দেয়ালে এসে বসে পড়বো। কাওরান বাজারে টিসিবির পণ্য কেনার লাইনের ছবি। অনেকের মুখ আড়াল করার চেষ্টা। দেখেই বুঝা যায় লাইনে দাঁড়ানো লোকজন কোনো অফিসের চাকরিজীবী। অফিসের ফাঁকে দৌড়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছেন কম দামে পণ্য কিনতে। দিন যতই গড়াচ্ছে ততই লাইনে বাড়ছে মধ্যবিত্তের চাপ।