দেশপ্রেম কেন হারিয়ে যাচ্ছে?

0

ইকতেদার আহমেদ
পাশের রাষ্ট্র ভারত স্বাধীনতা-পরবর্তী ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের কারণে সে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হলেও সে দেশের সংখ্যালঘু জনগণ বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশত্যাগ করে পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বর্তমানে নেই বললেই চলে; কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে ঠিক উল্টোটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন অনেক বৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন যারা সারা জীবন বাংলাদেশে চাকরি করে অবসর গ্রহণের পর নিজেদের ভূ-সম্পত্তি বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং সমগ্র জীবনের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। অনেক সরকারি কর্মকর্তাকে দেখা গেছে, এ দেশে চাকরিতে থাকাকালেই ভারতে বাড়ি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেছেন। আবার এমন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা অবসর গ্রহণের পর চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে নিয়োজিত হয়েছেন; কিন্তু পরিবারের দিকে তাকালে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী ব্যতীত পরিবারের অন্যরা ভারতে বসবাস করছে। এ ক্ষেত্রে একজন চাকরিজীবী এ দেশে চাকরি করার পর অবসর গ্রহণ করে যদি ভারতে পাড়ি জমান অথবা এ দেশে কায়ক্লেশে জীবন-যাপন করে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভারতে পাঠিয়ে দেন, সেটি কী ধরনের দেশপ্রেম তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে পুরোপুরি ‘ভারতীয়’ই ভাবে। এদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাতে পাড়ি জমালেও তারা সবাই দেশের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে এবং প্রতি দুই চার পাঁচ বছর অন্তর দেশে এসে আত্মীয়স্বজনের সাথে কিছুদিন থেকে নিজেদের বাড়িঘর উন্নয়ন এবং বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক কাজে অর্থ ব্যয় করে জাতীয় উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। ভারতের অধিকাংশ জনগণের মধ্যে দেখা যায়, তারা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়ের ব্যাপারে দেশে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে; কিন্তু বাংলাদেশের বৃহৎ সংখ্যালঘুদের মধ্যে এর বিপরীতটি পরিলক্ষিত হয়। একদিন সরকারি এক অফিসে করণিককে দেখা গেল, আগে কর্মরত ছিলেন এমন একজন কর্মকর্তার সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা করণিককে কী বিষয়ে কথা হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে করণিক জানান, তিনি যে টেলিভিশনটি ব্যবহার করেন, সেটি ভারতীয়। টিভিটির কিছু যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে সেটি অচল। তাই খুচরা যন্ত্রাংশগুলো ভারত থেকে আনার ব্যাপারে করণিকের সাহায্য কামনা করেছেন। বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা বিস্তারিত অবহিত হওয়ার পর করণিককে বললেন- এ ব্যাপারে আপনার সহযোগিতা করা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী হবে। কেননা আগের কর্মকর্তার টেলিভিশন সেটটি চোরাই পথে বাংলাদেশে ঢুকেছে এবং এটিকে সচল করতে হলে যে খুচরা যন্ত্রাংশের প্রয়োজন তা-ও ভারত থেকে চোরাই পথে আনতে হবে। বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা করণিককে যেভাবে আগের কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে নিবৃত্ত করলেন, তার মাধ্যমে দেশের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে গণচীন থেকে আমদানিকৃত খুচরা যন্ত্রাংশের মাধ্যমে বিভিন্ন নামে স্থানীয় ব্র্যান্ডের টেলিভিশন সেট সংযোজিত হচ্ছে। এ সব টেলিভিশন সেটের খোলসসহ বেশ কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ বর্তমানে বাংলাদেশেই প্রস্তুত হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত এ সব টেলিভিশন সেটের ওয়ারেন্টি তিন থেকে সাত বছর। তা ছাড়া এসব টেলিভিশন সেট গুণে ও মানে যে কোনো ভারতীয় টেলিভিশন সেটের চেয়ে উৎকৃষ্ট। অপর দিকে আমাদের বাজারে সম্পূর্ণভাবে বিদেশে সংযোজিত যেসব টেলিভিশন সেট পাওয়া যায় সেগুলো গুণে ও মানে এবং মূল্যের দিক থেকে ভারতীয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের টেলিভিশনের চেয়ে উন্নততর ও সাশ্রয়ী। একজন বাংলাদেশী যার মধ্যে দেশপ্রেম আছে, তিনি কখনো নিম্নমানের ভারতীয় টেলিভিশন সেট ক্রয়ে আগ্রহী হবেন না। তাই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত দ্রব্য সামগ্রী সাশ্রয়ী মূল্য হওয়া সত্ত্বেও কেন আমাদের বৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তি ভারতে প্রস্তুত করা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী যার অধিকাংশই চোরাই পথে ঢোকে, ক্রয়ে আগ্রহী? বাংলাদেশের বৃহৎ সংখ্যালঘুদের অনেকের এ ধরনের মানসিকতা দেখে আমাদের দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং সরকারের শীর্ষ নির্বাহীকে বলতে শোনা গিয়েছিল- ‘বাংলাদেশী হতে হলে পুরোপুরি বাংলাদেশী হতে হবে। এক পা ভারতে রেখে এবং এক পা বাংলাদেশে রেখে বাংলাদেশী হওয়া যাবে না।’
বাঙালি মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে উদার ও অতিথিপরায়ণ। সচরাচর দেখা যায় আমাদের কারো গৃহে এবং কোনো সরকারি বা বেসরকারি অফিসে ভারতীয়সহ কোনো বিদেশী অতিথি আসলে আমরা কোনো ধরনের ত্রুটি রাখি না আপ্যায়নে। আমাদের দেশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা যিনি তার কলেজ-জীবন পর্যন্ত কলকাতায় লেখাপড়া করেছেন, তার একজন কনিষ্ঠ সহকর্মীসহ মাদ্রাজে একটি কনফারেন্সে যোগদানের পথে কলকাতায় আট ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি করলে তার এক বাল্যবন্ধুর বাসায় দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করা হয়। বাল্যবন্ধুর সাথে আমাদের দেশের পদস্থ কর্মকর্তার প্রায় ৫০ বছর পর প্রথম দেখা। কিন্তু কলকাতার বন্ধু তার বাংলাদেশী বাল্যবন্ধুকে মধ্যমমানের আতিথেয়তায় আপ্যায়ন করেন। যা হোক, বাংলাদেশী কর্মকর্তা ও তার কনিষ্ঠ সহকর্মী এ আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট ছিলেন। বাংলাদেশী বন্ধু যখন তার কলকাতার বন্ধুকে বললেন ফেরার পথে যদিও কলকাতায় রাতযাপন করতে হবে, তখন তোমাকে কষ্ট না দিয়ে যেকোনো একটি হোটেলে রাত যাপন করব। এর উত্তরে বাল্যবন্ধু বললেন, সে-ই ভালো। মাদ্রাজ পৌঁছার পর আরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। বাংলাদেশী পদস্থ কর্মকর্তা মাদ্রাজের একই কার্যালয়ের পদস্থ কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করলে তার বাসায় বিকেলে চায়ের আমন্ত্রণ জানানো হয়। চায়ের আমন্ত্রণে গিয়ে দেখা গেল, তার বাসায় অফিস কক্ষে স্রেফ দুধ চা ও ব্রিটানিয়া বিস্কুট (আমাদের দেশের ‘এনার্জি প্লাস’ বিস্কুটের সমতুল্য) দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। আমাদের যেকোনো পদস্থ কর্মকর্তার গৃহে ভারতের এ ধরনের পদস্থ কর্মকর্তার আগমন ঘটলে নিঃসন্দেহে বলা যায় বিকেলে চা খাওয়ার সময় যেসব নাশতা পরিবেশন করা হতো তাতে হয়তো রাতে আর আহার গ্রহণের প্রয়োজন হতো না। ভারতীয়রা অভ্যাসগতভাবে মিতব্যয়ী। অতিথি যত বড় মাপেরই হোক, আপ্যায়নের ক্ষেত্রে সীমারেখা অতিক্রম করতে তাদের দেখা যায় না। আমরা যদিও এর উল্টোটি করে স্বস্তিবোধ করি; কিন্তু আমাদেরও হয়তো ভাববার সময় এসেছে আপ্যায়ন সেটি সরকারি বা বেসরকাররি অথবা নিজ গৃহেই হোক তা পরিমিতির মধ্যে রাখাই ভালো। পরিমিত খাদ্য গ্রহণ অপচয় রোধের পরিচায়ক এবং অপচয় দেশপ্রেমের পরিপন্থী। আমাদের দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর অপ্রতুলতার কারণে দু’বেলা পেট পুরে তৃপ্তিসহকারে আহার করতে পারছে না। এর বিপরীতে বিত্তবানদের গৃহে ও বিত্তবানদের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়, উপাদেয় খাদ্যের ছড়াছড়ি এবং একজন ব্যক্তি তার প্রকৃত চাহিদার চেয়ে আরো ৩০-৪০ শতাংশ বেশি খাদ্য গ্রহণ করছে। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দু’বেলা সুষম খাদ্যের নিশ্চয়তার বিধান করতে না পারব-ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উচিত হবে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ভূরিভোজনের আয়োজন না করা। চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম উন্নত কাষ্ঠসম্পদ দ্বারা সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে আজ থেকে ১০০ বছর আগেও এ অঞ্চলের কাঠের কাঠামোর সমুদ্রগামী জাহাজ প্রসিদ্ধ ছিল এবং এসব জাহাজ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি কাঠের কাঠামোর জাহাজ প্রস্তুতের ব্যাপারে আগ্রহ পোষণ করলে জাহাজটির জন্য যে কাঠের প্রয়োজন তা চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে আহরণ সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে শান্তিবাহিনী দমনের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সড়কের দু’ধারে যত পুরাতন বৃক্ষ ছিল তা নির্বিচারে নিধন করা হয়েছে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোনো সড়কের দু’ধারে তাকালে ১০ মাইল ডান বা বাম দিকে ১০ বছরের অধিক পুরনো কোনো বৃক্ষের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যেসব রাষ্ট্র পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণতারোধে বৃক্ষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশে যে হারে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে এটা চলতে থাকলে আমরা অচিরেই পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান বৃক্ষনিধনে কারা দায়ী- এ বিষয়টি সবার জানা থাকলেও এদের ব্যাপারে অযাচিত নিপীড়নের ভয়ে কেউ মুখ খুলে কিছু বলার সাহস পান না। কোনো এক বিশেষ শ্রেণী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থেকে এভাবে বৃক্ষনিধনের মাধ্যমে বিশেষ আবাসিক এলাকায় কাঠের যথেচ্ছ ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ করবে- স্বাধীনতার উদ্দেশ্য তো এটা ছিল না।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ পাহাড় বৃক্ষশূন্য। যেকোনো ব্যক্তি সড়ক বা রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় ফেনী জেলার সীমানা অতিক্রম করার পর বাম দিকে তাকালে দেখবেন উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত সারি সারি পাহাড়গুলো সম্পূর্ণরূপে বৃক্ষশূন্য। আমাদের এশিয়া মহাদেশের মালয়েশিয়া ও জাপানের দিকে তাকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। মালয়েশিয়া ও জাপানের শহরাঞ্চলের বাইরে সব পাহাড় বৃক্ষ দ্বারা আচ্ছাদিত এবং এ সব পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সুউচ্চ বৃক্ষ দ্বারা দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কারো পক্ষে পাহাড়ের চতুর্দিকের দৃশ্যগুলো অবলোকন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে মালয়েশিয়া ও জাপানের পাহাড়গুলোয় লাখো-কোটি যে সুউচ্চ বৃক্ষ রয়েছে তা দিয়ে সমগ্র পৃথিবীর আগামী ২০ বছরের কাঠের চাহিদা মেটানো সম্ভব। আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিক, সরকারি ও বেসরকারি পদস্থ অনেকের জাপান ও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ হয়েছে; কিন্তু আমরা উভয় দেশ থেকে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি তা কি আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য কাজে লাগিয়েছি? আর যদি কাজে লাগিয়ে না-ই থাকি, তাহলে এ ধরনের সফরে গিয়ে কী লাভ? পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের জাতীয় নেতা ও খেলোয়াড়দের দেখা যায়, যখন কোনো অনুষ্ঠানে সেসব দেশের জাতীয়সঙ্গীত বাজানো হয়, তখন জাতীয় নেতা ও খেলোয়াড়রা বুকে হাত দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে জাতীয়সঙ্গীত গাইতে থাকেন। এটি দেশপ্রেমের একধরনের হৃদয়নিংড়ানো বহিঃপ্রকাশ। আমাদের একজন শীর্ষ জাতীয় নেতা যিনি একাধিকবার সরকারের শীর্ষ নির্বাহী পদে আসীন হওয়ার সুযোগ লাভ করেছেন তার মধ্যে এ প্রবণতাটি লক্ষ করা গেলেও অপরাপর অনেকের মধ্যে এটি অনুপস্থিত। আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তিদের দেখা যায় তারা নিত্য যে শাড়ি পরিধান করে থাকেন তা মূল্য ও মানের বিবেচনায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে। তারা প্রতিদিন এ ধরনের দুই তিনটি শাড়ি পরিধান করে থাকেন। তারা বেশভূষা ও প্রসাধনীতে প্রতিদিন যে অর্থ ব্যয় করেন তার সমষ্টিগত মূল্য দিয়ে প্রতিদিনই একটি গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব। এ আঙ্গিকে যদিও বিষয়টি ভাববার অবকাশ আছে তারা বা তাদের অনুগামীরা কখনো কি দেশের কল্যাণে বিষয়টি ভেবে দেখেছেন? সরকারের একজন শীর্ষ নির্বাহীকে দেখা গেল, ক্ষমতায় থাকাকালীন ইজারার মাধ্যমে প্রাপ্ত নিজস্ব বলে দাবিকৃত বাসভবনে বসবাস করে মাসিক ৩৫ হাজার টাকা ভাড়া উত্তোলন করেছেন, আবার বাড়িটি সংস্কারের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করিয়েছেন। বাড়িটি যদি নিজস্ব হয়েই থাকে, তবে এ সংস্কার বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ের সুযোগ ছিল কি না। আর যদি সুযোগ না-ই থেকে থাকে, তবে এ ধরনের গুরুতর অনিয়মকে প্রশ্রয় দিলে অন্যদের অনিয়মের ব্যাপারে ছাড় না দিয়ে উপায় কী?
১৯৭৩-৭৪ খ্রিষ্টাব্দে উপকূলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে বেড়িবাঁধের উভয় পাশে বিপুল পরিমাণ বৃক্ষ লাগানো হয়েছিল। বিগত সরকারগুলোর আমলে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এসব বৃক্ষ নিধন করা হয়। এ কারণে বর্তমানে ছোট ধরনের সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসেও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। একজন রাজনৈতিক নেতা বৃক্ষনিধনে নেতৃত্ব দেবেন, এটি কি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনা করা যায়! পৃথিবীর কোনো উন্নত রাষ্ট্রে মন্ত্রী ব্যতীত সরকারের অপর কেউ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গাড়ি ও চালক প্রাপ্ত হন না। আমাদের দেশের সামরিক ও বেসামরিক উপসচিব পর্যন্ত পদধারী কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদত্ত গাড়ি ও চালকের সুবিধা পেয়ে আসছেন। যখন এ সুবিধা প্রত্যাহার করে ভাতা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা চলছে, তখন শোনা গেল, সংসদ সদস্যদের রাষ্ট্রীয়ভাবে গাড়ি ও ও চালক প্রদান করা হবে। এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নের আগে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ধরনের সুবিধা চালু আছে কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা গাড়ি ও জ্বালানির যে অপব্যবহার হচ্ছে তা দেশের সমৃদ্ধির পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ আবেগপ্রবণ এবং তারা চায়, দেশ সঠিক নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধিত হোক। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, সামরিক ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তা, শীর্ষ ব্যবসায়ী ও শিল্প-কারখানার মালিক নিজেদের কথা, কাজ ও আচার-আচরণ দ্বারা তাদের অধীনসহ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে প্রেরণার উৎসে পরিণত করে নিজেদেরকে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা সামরিক শাসকদের দ্বারা বারবার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উভয় দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারেনি। এর ফলে কোনো দেশেই প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত হতে পারেনি। আমরা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে, যার মাধ্যমে আমরা হারিয়ে যাওয়া দেশপ্রেম ফিরে পেতে পারি।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক