সময় এসেছে মাস্কের ধরন বদলানোর

0

॥ জাকিয়া আহমেদ॥
দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে ঊর্ধ্বহারে। বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন উদ্বেগের মধ্যে বাংলাদেশেও নতুন রোগী শনাক্ত ও সংক্রমণের হার প্রতিদিনই আগের দিনের চেয়ে বাড়ছে। উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে স্বাস্থ্যবিধি মানায় অবহেলাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। শারীরিক দূরত্ব কিংবা জনসমাবেশ এড়িয়ে চলতে না পারলেও অনেকেই সচেতনভাবে মাস্কটা পরছেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মাস্কের ধরন বদলানোরও সময় এসেছে বলে মনে করছেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৪০ জনের। যা তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ছিল ৮৯২ জন। অর্থাৎ গত ২৪ ঘণ্টায় এক লাফে ২৪৮ জন রোগী বেশি শনাক্ত হয়েছেন। দেশে এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একদিনে এক হাজার ১৭৮ জন করোনা শনাক্ত হয়েছিলেন। এর মাঝে আর একদিনে এত বেশি কোভিড আক্রান্ত হয়নি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নতুন বছরের শুরু থেকেই করোনা রোগী শনাক্তের হার বাড়ছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম ৬ দিনে যথাক্রমে শনাক্ত হয়েছেন ৩৭০, ৫৫৭, ৬৭৪ ,৭৭৫, ৮৯২ এবং ১ হাজার ১৪০ জন। আর শনাক্তের হার ২ দশমিক ৪৩, ২ দশমিক ৯১, ৩ দশমিক ৩৭, ৩ দশমিক ৯১, ৪ দশমিক ২০ এবং ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে দেশে অতি সংক্রমণশীল ওমিক্রনের প্রভাব রয়েছে ভাবলেও সরকারের রোগ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, এখনও দেশে ওমিক্রন নয়, বরং ডেল্টার প্রভাব চলছে। সেইসঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে চরম উদাসীনতা।
এমন পরিস্থিতিতে কাপড়ের মাস্ক না পরতেই উৎসাহিত করছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, হয়তো এই মাস্ক ভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাযথ সুরক্ষা দিতে পারছে না। কাপড়ের মাস্কের বদলে তারা সার্জিক্যাল মডেলের বা আরও শক্তিশালী শ্বাসযন্ত্রের মাস্ক ব্যবহার করার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছেন। তারা বলছেন, এক স্তরের কাপড়ের মাস্ক অনেক মানুষের কাছে আরামদায়ক এবং স্টাইলের জন্য উপযুক্ত। ভাইরাসের বড় ড্রপলেট আটকাতে পারলেও ভাইরাসবাহী বায়ুকণা বা পার্টিকেল ঠেকানোর ক্ষেত্রে এমন মাস্ক কার্যকর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) সর্বশেষ নির্দেশনায় কাপড়ের একাধিক স্তরের মাস্ক, আঁটসাঁটভাবে আটকানো এবং নাক পুরোপুরি ঢেকে রাখতে পারে এমন মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কাপড়ের মাস্কের নিচে বহুস্তরের একবার ব্যবহারযোগ্য মাস্ক পরা যেতে পারে। আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এন৯৫ মাস্ক সুপারিশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সিডিসি বলছে, কিছু নির্দিষ্ট মাস্ক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কাপড়ের মাস্ক অন্তর্ভুক্ত নয়। উন্নতমানের সার্জিক্যাল মাস্ক সঠিকভাবে পরিধান করা হলে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু ওমিক্রনের বিরুদ্ধে এসব মাস্ক কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে আরও তথ্য ও গবেষণা প্রয়োজন।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, ওমিক্রন অনেক বেশি সংক্রমণশীল- এটা প্রমাণিত। এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, অন্যান্য যেসব ভ্যারিয়েন্ট এর আগে এসেছে তার চেয়ে ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা দুই থেকে তিনগুণ বেশি। গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রনে পুনর্বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই সঙ্গে যারা আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্ত, বিশেষ করে ক্যান্সার, কিডনি রোগ- যাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়, তারা যদি ওমিক্রনে আক্রান্ত হন তাহলে এর জটিলতা অন্যদের ক্ষেত্রে কম হলেও তাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। ‘করোনা প্রতিরোধে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে, সেটা যে ভ্যারিয়েন্টই হোক না কেন’, মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, তবে ওমিক্রন প্রতিরোধে কাপড়ের মাস্কের চেয়ে মেডিক্যাল গ্রেডের মাস্ক বেশি কার্যকর বলা হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, গত কয়েক দিন ধরে করোনায় শনাক্তের হার বাড়ছে। অনেক দিন পর আজ (৬ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি ল্যাবে ৯৫ জনের করোনার পরীক্ষা হয়েছে, তার ভেতরে ১১ জন শনাক্ত হয়েছেন, গতকাল ৮২ জনের মধ্যে সাত জন ছিলেন পজিটিভ। তিনি বলেন, ওমিক্রন অনেক বেশি সংক্রমণশীল। তাতে বর্তমানে যেসব ফ্যাশনেবল কাপড়ের মাস্ক পরছেন সবাই, সেখানে মাস্কে বদল আনতে হবে। সার্জিক্যাল মাস্ক মুখে এঁটে থাকে, টাইটলি… এটা কাপড়ের মাস্কে হয় না।’
করোনা
কাপড়ের মাস্ক পরিহিতদের বেশিরভাগ সময়ই মাস্ক ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাস্ক দিয়ে ভাইরাসকে আটকানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বেশিরভাগ কাপড়ের মাস্কেই নাক ঢেকে রাখার মতো ক্লিপ নেই- এতে করে রিস্ক বেশি থাকছে। আর ওমিক্রন বেশি সংক্রমণশীল আগের অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলো তুলনায়। ডেল্টাতে যতটা ভাইরাসে মানুষ সংক্রমিত হতো, ওমিক্রনে তার চেয়েও কম ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে- এটাই রিস্কের জায়গাটা। যার জন্য এখন কাপড়ের মাস্কের বদলে আঁটোসাঁটো মাস্ক, যেটা নাক মুখ ভালো করে ঢেকে রাখবে তার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘অবশ্যই সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে হবে’ উল্লেখ করে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা প্রায় কমেই গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিনে সেটা আবার বেড়েছে। আর চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি আবার আগের মতো সংক্রমিত হতে থাকে তাহলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এদিকে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান জানান, শুধু ওমিক্রনের ক্ষেত্রে নয়, সব ভ্যারিয়েন্টের বেলাতেই কাপড়ের মাস্কের তুলনায় সার্জিক্যাল মাস্ক বেশি সুরক্ষা দেবে। কাপড়ের ফ্যাশনেবল মাস্কের তুলনায় মেডিক্যাল মাস্ক অনেক বেশি সুরক্ষা দেয়- এটা আগেই প্রমাণিত। আজকাল বেশিরভাগ মানুষই কাপড়ের মাস্ক পরছে, কিন্তু কাপড়ের মাস্ক কার্যকর নয়। আর এখন এই অতি সংক্রমণশীল ওমিক্রনের বেলাতে আরও নয়। এটা এখন সবার মেইনটেইন করা উচিত। সংক্রমণ বাড়ছে, কাপড়ের মাস্কের কার্যকারিতা কম মেডিক্যাল মাস্কের চেয়ে, তাই সবার তিন স্তরের মেডিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। ওমিক্রন নিয়ে হেলাফেলা করার কোনও সুযোগই নেই, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে—নয়তো আবার আমরা এক ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, সতর্ক করেন ডা. জাহিদুর রহমান।