ভাষা সংগ্রাম থেকে বিজয়ের ইতিহাস যেখানে

0

সাইফুর রহমান, রাবি॥ ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের বজ্রকণ্ঠে যখন ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল তৎকালীন পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রতিটি রাজপথ। সেই সময় থেকে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরে ‘জয় বাংলা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়া মুক্তিকামী বাঙালির লড়াইয়ের গল্প আজ নতুন প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। গৌরবোজ্জ্বল এই ইতিহাস জানাতে হাজারো স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’। ঊনসত্তরের গণবিক্ষোভ। শিক্ষার্থীদের হুংকারে লেজগুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানী বাহিনী। পেছন থেকে তাড়া করে অনবরত ইটপাটকেল ছুড়ছে বাঙালি সূর্য সন্তানেরা। রাবি শিক্ষকদের মিছিলের অগ্রভাগে শহীদ শামসুজ্জোহা, হাসপাতালের কফিনে শায়িত ড. জোহার ছবি। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা কৌশলী আক্রমণে পরাস্ত হয়েছে পাক সেনারা। দলবল নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে বাঙালির কাছে। এমন অসংখ্য চিত্র খুব যত্নসহকারে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার সংরক্ষণে প্রদর্শন করা হয়েছে। অন্য একটি গ্যালারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হামলায় আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের করুণ চিত্র, কিশোরদের ওপর নির্যাতন, গণঅভ্যত্থানের গণআন্দোলন থেকে বাঙালিদের বেঁধে টেনে-হিচড়ে নেওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া অজ্ঞাতনামা শহীদদের হাঁড়-গোড় সংরক্ষণ করা হয়েছে এই সংগ্রহশালায়। এছাড়া আরও রয়েছে প্রখ্যাত শিল্পী মোস্তফা মনওয়ারের শিল্পকর্ম, সুজা হায়দারের বর্ণমালা, আবু তাহেরের অসহায় আত্মা, উত্তম দে’র কোলাজ ‘মুক্তিযোদ্ধার শার্ট’, প্রণব দাসের ভাস্কর্য ‘আর্তনাদ’।
এছাড়া বাঙালিদের ওপর নির্মম নির্যাতনে ব্যবহৃত পাকিস্তানিদের ছুরি, বুলেট, রকেট লঞ্চার, বিধ্বংসী মাইন এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনা গণহত্যার হৃদয় বিদারক দৃশ্যসহ দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বহু স্মৃতিকে ধারণ করেছে এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আরও রয়েছে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তির আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্রকর্ম, দলিল-দস্তাবেজ, আলোকচিত্র, জামা, জুব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ বিভিন্ন দুর্লভ সংগ্রহ। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান, তাদের কাছে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা পাঠাগার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে নেমে সামনে তাকালেই দেখা যাবে প্রশাসনিক ভবন। প্রশাসন ভবন থেকে সোজা পূর্ব দিকে প্যারিস রোডের শেষ মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে অবস্থিত দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী সংগ্রহশালাটি। যা এখন দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবেও অধিক পরিচিত। এটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর এখানে নিয়মিত দর্শন করতে আসেন শতাধিক দর্শনার্থী।
৬৬০০ বর্গফুট আয়তনের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় মোট তিনটি গ্যালারি রয়েছে। খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সংগ্রহশালাটি যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে এটি মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়ের নির্মিত শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চের গ্রিন রুমেই গড়ে উঠে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহশালাটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে নির্ধারিত স্থান না থাকায় বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এটা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হতো। পরে ১৯৮৯ সালের ২২ মার্চ রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ সংগ্রহশালার মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনটি গ্যালারি মিলিয়ে বর্তমানে এতে মোট ৭৫০টি প্রদর্শনী রয়েছে। প্রথম গ্যালারিতে ৫৯টি আলোকচিত্র, ৬টি প্রতিকৃতি, ২টি কোলাজ, ৮টি শিল্পকর্ম, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৭টি, ভাস্কর্য ১টি, ডায়েরি ও অন্যান্য পাণ্ডুলিপি ৪টি এবং বাঁধাইকৃত ২টি আলোকচিত্র রয়েছে। দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, ৯টি শিল্পকর্ম, ১৯টি বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, ৩টি ভাস্কর্য, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৯৯টি এবং ৫টি ডায়েরি। এছাড়া, স্বাধীনতাযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় ৪ নেতা এবং রাবির শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি; বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ; স্বাধীনতার ঘোষণা-বাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ঢাকার রাজপথ, ’৭১-র গণবিক্ষোভ, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ’৭১-র ছাত্রী নিগ্রহ, ধর্ষিত মাতা-জায়া, গণহত্যা, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজপথ; পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র, মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার, শিল্পীদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য, শহীদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহীর শহীদদের বিভিন্ন আলোকচিত্র। তৃতীয় গ্যালারিতে আছে ১১২টি আলোকচিত্র, ১টি প্রতিকৃতি, ১১টি শিল্পকর্ম, ১টি বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, ৬টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরি-পাণ্ডুলিপি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৫৬টি। পরবর্তী সময়ে এ সংগ্রহশালায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন আলোকচিত্র সংরক্ষণ করা হয়। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি দর্শন করতে প্রতিদিন শতাধিক দর্শনার্থী আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শহীদ মিনার কমপ্লেক্স সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি আছে। রাবি উপাচার্য হলেন এই কমিটির সভাপতি। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর অধ্যাপক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সংগ্রহশালাটিও দীর্ঘদিন খোলা হয়নি। তবে এখন খোলার পর থেকে আবার দর্শনার্থী আসতে শুরু করেছেন। প্রতিদিন প্রায় দেড় শতাধিক দর্শনার্থী এখানে আসেন। আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া শহীদদের নিদর্শন সংগ্রহ করে থাকি। তবে সেটা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে। ভবিষ্যতেও আমাদের এ নিদর্শন সংগ্রহ অব্যাহত থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।