শার্শার বাগআঁচড়া উলাশী ও কায়বায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতা, বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোরের শার্শা উপজেলার একাধিক ইউনিয়নে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাগআঁচড়া, উলাশী ও কায়বা। বিজয়ী ও পরাজিত উভয় প্রার্থীর কর্মীরা পরষ্পরের প্রতি হামলা চালাচ্ছে। বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় শতাধিক বাড়ি ঘর ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। রোববার রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিল থেকে এ হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুলকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতীকের আব্দুল খালেক। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, নৌকায় ভোট দেয়ায় তাদের উপর হামলা চালিয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতীকের আব্দুল খালেক’র কর্মী সমর্থকরা। তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক দাবি করেছেন, প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৭/৮ জন মেম্বর প্রার্থী ছিলেন। তাদের সমর্থকরাই সংঘর্ষ ভাঙচুরে জড়িয়ে পড়েছেন। এদিকে উলাশীর চেয়ারম্যান ও সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আয়নাল হকও তার এলাকায় সহিংসতার অভিযোগ করেছেন।


স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভোটগণনা শেষে রোববার রাতে বাগআঁচড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড বসতপুর ২ নং কলোনিতে আনারস প্রতীকের বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ফেরার পথে নৌকার সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই পাড়াতেই অন্তত দশটি বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। ভাংচুর করা হয়েছে দোকানপাট, মিনিবাস, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল। আহত হয়েছে অন্তত দশজন। এলাকার পুরুষরা ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ওই বাড়িগুলোতে নারী ও শিশুরা অবস্থান করছেন।  ওই এলাকার বৃদ্ধ গনি পাঠান জানালেন, তার ছেলে সুখচান নৌকায় ভোট দেয়ায় তার বাড়ির সামনে বোমা মেরেছে। কুপিয়ে পিটিয়ে ভাংচুর করেছে টিনের ঘর। ধারদেনা করে ঘরটি তৈরি করেছেন; এখনও দেনাও শোধ হয়নি। নাসির উদ্দিনের স্ত্রী নুরনাহার অভিযোগ করেন, আব্দুল খালেকের লোকজন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে নিয়ে এসে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের সাথে দু’জন পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা কোনো ভূমিকা রাখেনি বলেও তিনি অভিযোগ করেন। বৃদ্ধা ফাতেমা বেগম হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তার উঠানে ভাঙ্গা পড়ে আছে মিনিবাস। বিদেশ থেকে মেয়ের পাঠানো টাকায় গাড়িটি কেনা। সেটি ভাঙ্গার পর তার বাড়ির দরজা জানালে ভেঙে তছনছ করেছে। ঘরে শুয়ে থাকায় ভাঙা কাঁচে তার কপালও কেটে গেছে। শুধু বসতপুর দুই নং কলোনিতেই নয়; হামলার ঘটনা ঘটেছে ২ নং ওয়ার্ডে, পিপড়াগাছি গ্রামে, মহিষাকুড়া এলাকায়। সবমিলিয়ে অন্তত শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মহিষাকুড়া বাজারে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা ভাংচুর চালিয়ে নৌকার প্রতিকৃতি খুলে এনে আনারসের কার্যালয়ের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।


বাগআঁচড়া ইউনিয়নে পরাজিত নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুল অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচনে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এনে আনারসকে বিজয়ী করা হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পর তার কর্মী সমর্থকদের বাড়ি ঘরে হামলা ভাঙচুর তা-ব চালানো হয়েছে। ভয়ে কর্মী সমর্থকরা বাড়ি থাকতে পারছেন না। তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক। তার দাবি, প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৭/৮ জন মেম্বর প্রার্থী ছিলেন। তাদের সমর্থকরাই বিরোধ সংঘর্ষ ভাংচুরে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি এলাকায় পরিস্কার ঘোষণা দিয়েছেন, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তিনি কোনো দায় নেবেন না। অপরাধীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। তিনি আরও দাবি করেন, নিজেই হামলার শিকার হয়েছেন। তার কর্মী সমর্থকরাও আহত হয়েছেন।
এদিকে, রোববার রাতের ওই হামলার পর সোমবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। অপরদিকে শার্শার উলাশী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আয়নাল হক অভিযোগ করেন, তার উলাশীতে ৮জন ইউপি সদস্য হুমকির মুখে রয়েছেন। তারা বর্তমান ইউপি সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনেকে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। তিনি বলেন কবির মেম্বার, কালাম মেম্বার, মিলন মেম্বার, হাফিজুর মেম্বার ও হাসান মেম্বারকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। বাড়ির বাইরে বের হলে তাদের ওপর হামলার আশঙ্কা করছেন তারা। চেয়ারম্যান আয়নাল হক বলেন, রামপুর বাজারে ‘মোল্লার হোটেল’ এর মালিক মোল্লার কাছে ৪ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। মোল্লা হোটেল বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ ছাড়া রামপুর বাজারে হাফিজুর মেম্বারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে গ্রাম পুলিশ সদস্য আব্দুস সালামকে। তিনি আরও বলেন স্থানীয় নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য সুলতান আহম্মেদ বাদশার ছেলে ও কর্মী-সমর্থকরা এর সাথে জড়িত রয়েছেন্ । আর এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুবলীগ নেতা উলাশীর সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল আলমের ছেলে সাইদুজ্জামান বিটন। তিনি বিষয়টি প্রশাসনের দৃষ্টি কামনা করেছেন।  যশোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নাভারণ সার্কেল) জুয়েল ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, যেসব এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ গ্রহণসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবেও তিনি উল্লেখ করেন।


নাভারণ (যশোর) সংবাদদাতা জানান, কায়বা ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা চালাচ্ছে বিজয়ী বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থীর কর্মীরা। ঘরবাড়ি ভাঙচুর, মারধর ও বাড়ির সামনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কায়বা ইউনিয়নের পরাজিত নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী ফিরোজ হাসান টিংকু জানান, গত রবিবার রাত থেকেই কায়বার বিভিন্ন ওয়ার্ডে বসবাসকারী নৌকার সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালাচ্ছে ভোটে বিজয়ী বিদ্রোহী চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনের কর্মীরা। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান আলতাফের কর্মীরা রবিবার রাতে কায়বার বায়কোলা গ্রামে নৌকার কর্মীদের ২০টি বাড়ি ভাঙচুর করেছে। বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিচালী গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাদামতলা বাজারে কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করেছে। রাড়িপুকুর ওয়ার্ডে নৌকার অফিস ভাঙচুর করেছে। নৌকার কর্মী সহিদুল ইসলামের বাড়ি ভাঙচুর করেছে। দাঁদখালীতে নৌকার এক কর্মীকে মেরে মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছে। ফোন করে থানায় জানালেও পুলিশ নীরব ভুমিকা পালন করছে। আর এসব তান্ডব চালাচ্ছে সদ্য পাশ করা চেয়ারম্যানের কর্মীরা। থানায় অভিযোগ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ফিরোজ হাসান টিংকু বলেন থানায় ২টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। অ্যাডিশনাল এসপি সাইফুল ইসলামকে ভিডিও ফুটেজ দেওয়া হয়েছে।


এ ব্যাপারে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন জানান, আমি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই আমার কর্মীদের বলেছি ফলাফল যায় হোক না কেন কেউ যেন কোন রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে। আমার বা আমার কর্মীদের নিয়ে ঘর বাড়ি ভাঙচুর ও হুমকি ধামকির যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট। এমন কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারবে না? নৌকার প্রার্থী টিংকু নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় সে এখন বিভিন্ন জায়গায় আমার নামে এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। তবে আজ (মঙ্গলবার) সকালে করসার আলী মেম্বার ও নুরু কামারের সমর্থকদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। এ মারামারির সাথে আমি বা আমার কোনো কর্মী জড়িত নয়। এ ব্যাপারে শার্শা থানার অপিসার ইনচার্জ বদরুল আলম খান জানান, নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর বাগআঁচড়া ও কায়বায় ঘরবাড়ি ভাঙচুর ,হামলা ও নৌকার সমর্থকদের মাধরের ঘটনা শুনেছি। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। বাগআঁচড়া ও কায়বায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।