সহিংসতার শঙ্কার মাঝেই আজ যশোরে তিন উপজেলার ৩৫ ইউনিয়নে নির্বাচন

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চরম সহিংসতার আশঙ্কার মধ্য দিয়ে আজ রোববার তৃতীয় ধাপে যশোরের তিনটি উপজেলার ৩৫ ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত ১১ নভেম্বরের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের পর তৃতীয় দফার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও মনোনয়ন বঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে যে মাত্রায় সহিংসতা, খুনোখুনি, হানাহানির ঘটনা ঘটেছে তাতে আজকের ভোট নিয়েও অজানা শঙ্কা রয়েছে জনমনে। তবে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন বলছে, নির্বাচন অবাধ, সষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে বলপ্রয়োগ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রশাসন।
তবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ভোটার ও প্রার্থীরা চরম সংশয়ে রয়েছেন। ইতিমধ্যে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে রাজনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর যারা চাপ উপেক্ষা করে টিকে আছেন তাদেরকে নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা হামলা, হুমকি ধামকি দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এমনকি ঘর থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে শার্শার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মী খুন হয়েছেন তৃতীয় ধাপের এই নির্বাচনকে ঘিরে। নির্বাচনের একদিন আগেও জেলার বাঘারপাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়নে সহিংস ঘটনায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। এ অবস্থায় আজকের নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ হবে তা নিয়ে ভোটাররা শঙ্কিত। বিশেষ করে শার্শার নির্বাচনী পরিবেশ চরম ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আজ রোববার যশোরের মণিরামপুর, বাঘারপাড়া ও শার্শা উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে বাঘারপাড়া উপজেলায় ৯টি, মণিরামপুরের ১৬টি ও শার্শার ১০টি ইউনিয়ন রয়েছে। তিন উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ১ হাজার ৮৭৮ প্রার্থী। সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের লক্ষ্যে ২৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ৩ প্লাটুন বিজিবি ও ২ হাজার ৫৯১ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, তিন উপজেলায় ১ হাজার ৮৭৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে বাঘারপাড়া উপজেলায় ৯ টি ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ৫০ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী, সংরক্ষিত আসনে ১০২ ও সাধারণ আসনে ৩১৯ জন প্রার্থী। ৮১ কেন্দ্রের ৪৮৫ বুথে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভোট গ্রহণে দায়িত্ব পালন করছেন ৮১ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৪৮৫ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ ৯৭০ জন পোলিং এজেন্ট। এ উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৯ হাজার ১৭৫জন।
মণিরামপুরের ১৬টি ইউনিয়নে মোট প্রার্থী ৮৬৩ জন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ৭৮ জন, সংরক্ষিত ১৮০ জন ও সাধারণ আসনে ৬০৫ জন। এ উপজেলায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে ১৫২ কেন্দ্রের ৮০৫টি বুথে। নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করছেন ১৫২ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৮০৫ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও ১ হাজার ৬১০ জন পোলিং এজেন্ট। এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৯৪ হাজার ৯২১ জন।
শার্শা উপজেলার ১০ ইউনিয়নে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৪৪ জন প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান প্রার্থী ৪৩ জন, সাধারণ আসনে ৪০৬ জন ও সংরক্ষিত আসনে ৯৫ জন। এ উপজেলায় ১০৮টি কেন্দ্রে ৬২৭টি বুথে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন ১০৮ জন প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ৬২৭ জন ও পোলিং এজেন্ট ১ হাজার ২৫৪ জন। এ উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮ জন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান জানান, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে ২৭ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ৩ প্লাটুন বিজিবি নিয়োজিত থাকছে। কোথাও কোনো অনিয়ম হলে প্রশাসন তা কঠোর হস্তে দমন করবে। এর বাইরে তিন উপজেলায় ২ হাজার ৫৯২ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে মণিরামপুরে ১ হাজার ১৫৫, শার্শায় ৮০৩ ও বাঘারপাড়ায় ৬৩৪ জন রয়েছেন। জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনকে ঘিরে কোনো সহিংসতার সুযোগ দেয়া হবে না।
বাঘারপাড়া উপজেলা ঃ অনেকটা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যেই আজ বাঘারপাড়ার ৯ ইউনিয়নে ভোট শুরু হয়েছে। নির্বাচনের শেষ সময়ে হামলা, ভাঙচুর ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন। শুক্রবার রাতে উপজেলার জামদিয়া ইউনিয়নের আমুড়িয়ায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সর্বত্র টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই এখানে ৯টি ইউপিতে তৃতীয় ধাপের ভোট চলছে। এর মধ্যে রায়পুর ইউনিয়নে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ও বাকি আটটিতে ব্যালেটের মাধ্যমে ভোট নেয়া হচ্ছে। উপজেলার ৯টির মধ্যে ৭ ইউনিয়নেই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় অনেকটা চাপে রয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। উপজেলা নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ইতোমধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদিকে আজ ভোট চলাকালে জহুরপুর, রায়পুর, নারিকেলবাড়িয়া ও দোহাকুলা ইউনিয়নে সন্ত্রাস ও সহিংসতার আশঙ্কা করছেন সাধারণ ভোটাররা। বাঘারপাড়া থানা পুলিশের ওসি ফিরোজ উদ্দীন জানান, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পুলিশ সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে। সকল ইউনিয়নে পুলিশের পাশাপাশি পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।
মনিরুল ইসলাম মনি, শার্শা (যশোর) জানান, আজ ২৮ নভেম্বর রবিবার শার্শা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে নির্বাচন হচ্ছে। নৌকা প্রতীকের ১০ জন প্রার্থীসহ এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন ৪৩ জন। এছাড়া ১০ ইউনিয়নে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৯৫ জন ও সাধারণ সদস্য পদে ৪০৫ জন ভোট যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনে ১০টি ইউনিয়নে মোট ভোটার ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১৮ হাজার ১৭ জন ও মহিলা ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৩১ জন। মোট ভোট কেন্দ্র ১০৮টি। শার্শা উপজেলায় নির্বাচনী তফসিল ঘোষনার পর থেকে পানিসারা, গোগা, পুটখালী, বাগআঁচড়া, উলাশী, নিজামপুর, লক্ষনপুর, ডিহিসহ কয়েকটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের সাথে স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে বাগআঁচড়া ও গোগায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১ জন করে কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক কর্মী ও সমর্থক। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোটার সমর্থকদের ওপর হামলা, গভীর রাতে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, দোকানপাট ভাঙচুর ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে উলাশী ও গোগা ইউনিয়নে। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষের লোকজন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারেন সে জন্য নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কর্মীরা চাপ প্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে। এদিকে প্রার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে উপজেলার ১০৮টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে অনেক কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষনা করা হয়েছে। এদিকে নির্বাচন অবাধ, সষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সার্বিক সহযোগিতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ স্ট্রাইকিং ফোর্স, বিজিবি টিমসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য দিনভর শার্শা উপজেলায় অবস্থান করবেন বলে উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. মেহেদী হাসান জানিয়েছেন। একাধিক সূত্র জানায়, শার্শার বাগআঁচড়া, গোগা, বাহাদুরপুর, ডিহি, লক্ষনপুর ও নিজামপুর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যে কারণে এই ইউনিয়নগুলোতে সন্ত্রাস, বোমাবাজির আশঙ্কা রয়েছে। এই ইউনিয়নগুলোতে নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকরা বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের ভাড়া করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে বাড়আঁচড়া ইউনিয়নের সাতমাইল, বড় কলোনি, ছোট কলোনি, বসতপুর, সামটা কেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট কেটে নেওয়ার আশঙ্কা করছেন বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সূত্র মতে, কায়বা ইউনিয়নের ভবানিপুর, পাড়ের কায়বা, বায়কোলা, চালিতাবাড়িয়া ও মহিষা কেন্দ্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কেন্দ্রে সন্ত্রাসের আশঙ্কা করছেন সাধারণ ভোটাররা।