ভুয়া ফেসবুক আইডি’র ফাঁদ: ১৭০০০ নারীর যন্ত্রণা

0

ফাহিমা আক্তার সুমি॥
আশা রানী। সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবন শুরু করেছেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে আশা তৃতীয়। পরিবারের সঙ্গে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় থাকেন। স্কুল জীবনে পড়াশোনার মধ্যে আগ্রহ থাকায় বাবা-মা তাকে স্মার্টফোন কিনে দেননি। তবে এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও অনলাইনে ক্লাসের জন্য বাবা-মা তাকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেন। স্মার্টফোন পেয়ে আশা ফেসবুক আইডি খোলেন। ফেসবুক প্রোফাইলে তার একটি ছবিও দেন। আইডি খোলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয় পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি ফেসবুকেও সময় দিতেন আশা। কিন্তু ফেসবুক আইডি ব্যবহারের তিন মাসের মাথায় আশাকে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় এক পর্যায়ে তিনি কাউকে না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। ফেসবুকে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপমান থেকে তিনি নিরুদ্দেশ হতে চেয়েছিলেন। এজন্য ঘর ছাড়ার কথা জানিয়ে ছিলেন। পরে অবশ্য স্বজনদের অভয় পেয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।
ফেসবুকে ভুয়া আইডি’র ফাঁদে পড়ে আশার মতো বহু নারী এমন দুর্ভোগ আর যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে এমন প্রায় ১৭ হাজার নারী ফেসবুকে প্রতারণা বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। আশার পরিবারের সদস্যরা জানান, বাসা থেকে নিখোঁজ হওয়ার রাতে খুব ভয় পেয়েছিলেন তারা। হঠাৎ রাত ১১টার সময় আশা বাসার কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমরা বুঝতে পারিনি। এরপর বাসায় তাকে না দেখে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করি। রাতও গভীর হতে থাকে। বিভিন্ন রকমের খারাপ চিন্তা মাথায় চাপতে থাকে। অল্পবয়সী মেয়েটা এত রাতে বাসার বাহিরে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিকও মনে হচ্ছিল না। পরে একজন প্রতিবেশীর মাধ্যমে আশার সঙ্গে যোগাযোগ হয় পরিবারের। তারা জানতে পারেন আশা সাভারে অবস্থান করছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হলে আশা পরের দিন বাসায় ফিরে আসেন।
আশা বাসায় জানান, তার সঙ্গে খুব খারাপ একটা কাজ হয়েছে। ফেসবুকের ‘অবুঝ মন’ নামে একটি আইডি থেকে রিকোয়েস্ট আসে। এরপর কথা হয় মেসেঞ্জারে। কিন্তু কেউ কাউকে চিনি না। কিছুদিন পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে আমার ছবি চায়। আমি ভালো মনেই তাকে ছবি দেই। ছবি দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে সে আমার ছবিটি খুব বাজে ছবির সঙ্গে এড করে আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠায়। ছবি ছড়িয়ে দিবে বলে হুমকি দেয়। এরপর আমি বাবা-মায়ের ভয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। ছবিটা দেখার পরে আমার মনে হয়েছিল মারা যাবো। নেটে ছেড়ে দিলে সারা পৃথিবীর মানুষ আমার এই ছবি দেখবে। আমি তাকে ছবি না ছড়ানোর জন্য অনুরোধ করি। আমার অভিভাবকরা পুলিশে অভিযোগ করবে বলে তাকে জানাই। পরে তার ওই আইডি আর খুঁজে পাইনি। পরিবার এই বিষয়ে আমাকে অনেক সাহস দিয়েছে। বাবা বুঝিয়েছে ছবি সঠিক নাকি ভুল, মানুষ দেখলে বুঝবে। আমিও বাবা-মা’র কথা বুঝতে পেরে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেইনি। নতুন ফোন ও ফেসবুক ব্যবহার করায় বুঝতেই পারিনি একটা ছবি দিয়ে এভাবে ব্ল্যাকমেইল ও হয়রানির শিকার হতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টরা জানান, এমন প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারী লোকলজ্জায় আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেকেই সমাজে নানাভাবে অপমান-অপদস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে ফেসবুকে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে এক ধরনের প্রতারকরা নারীদের নানাভাবে হয়রানি করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগী নারীরা এসব বিষয়ে প্রায়ই অভিযোগ করছেন। অভিযোগের সূত্রধরে তারা এ ধরনের প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, ২০২০ সালের ১৬ই নভেম্বর সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের জন্য পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। সম্পূর্ণ নারী পুলিশ পরিচালিত এ সার্ভিসে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ হাজার ২৮০ জন ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে শতকরা ১৬ ভাগ নারীর বয়স ১৮ বছর। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ৮ হাজার ২২১ জন ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগের বিষয়ে প্রযুক্তিগত ও আইনি সহায়তা দিয়েছে এই ইউনিটটি। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার ১২ হাজার ৬৪১ জন ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ জিডি বা মামলা করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযুক্তের পরিচয় ও অবস্থান শনাক্ত করে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক বছরে যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ভুয়া আইডি ব্যবহার করে হয়রানির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি, যা মোট অভিযোগের ৪৩ শতাংশ বা পাঁচ হাজার ৪৭৫ জন। এ সময়ের মধ্যে ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে ১ হাজার ৮৮৪ জন নারীকে। আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও পাঠিয়ে হয়রানি করা হয় ৯৯২ জনকে। অন্যান্য উপায়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫১৮ জন। অভিযোগকারীর শতকরা ১৬ ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী। শতকরা ৫৮ ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ থেকে ২৪ বছর। ২৫-৩০ এর মধ্যে ভুক্তভোগী ২০ ভাগ এবং ছয় ভাগ ভুক্তভোগীর বয়স ৪০ বছরের বেশি।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, টেকনোলজির এ যুগে দেশের ৪ কোটি ২৬ হাজার মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছেন। ১৮ কোটি ২৫ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী রয়েছেন। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন। ফলে সাইবার জগতে ভিকটিম হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি। সুতরাং কেউ ঝুঁকি না জেনে সোশ্যাল মিডিয়ার অপরিচিত জগতে ঝাঁপ দেবেন না। আইজিপি আরও বলেন, আমরা চাই না সাইবার জগতে কোনো নারী বা পুরুষ ভিকটিম হোক। দুর্ভাগ্যবশত যদি কেউ ভিকটিম হন, তাহলে দয়া করে কেউ লুকিয়ে রাখবেন না। আমরা সাইবার অপরাধীদের দমন করতে চাই। বেশির ভাগ নারী ভুক্তভোগী মামলা না করায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। সুতরাং মনে সাহস রেখে, আইনগত পদক্ষেপ নিন। আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। ডিবি’র সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শরিফুল ইসলাম বলেন, ফেসবুকের ভুয়া আইডি খোলা কখনও কমানো যাবে না। ব্যক্তিগত আইডিকে সুরক্ষিত করতে হবে। নিজেদের আইডি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব কিন্তু নিজের। অন্য কেউ একজন ঘরে গিয়ে কিন্তু সুরক্ষিত করতে পারবে না। প্রোফাইল লক করা, অথেনটিকেশন দেয়া, কয়েকটি ট্রাস্টেট কন্ট্রাক দেয়া এই বিষয়গুলো ঠিক করতে হবে আগে। আইডিতে প্রবেশ করে কেউ যেন ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরি করতে না পারে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব কিন্তু এই কাজগুলো কখনই করে না। যারা করে তারা হলো তৃতীয় ব্যক্তি। প্রোফাইল যখন ওপেন থাকবে, আমার ভার্চ্যুয়াল জগতে আমি যখন সবকিছু ওপেন রাখবো তখনই এই হয়রানিগুলো করা সম্ভব। তিনি বলেন, এই ধরনের হয়রানির শিকার হবেন তাদেরকে আমরা আইনি সহযোগিতা করবো। আমাদের কাছে এলে জিডি করার মতো হলে জিডি করে দিচ্ছি। আবার এমনও অনেক ঘটনা আছে যেগুলোর মামলা করা হচ্ছে।