বিচারক কামরুন্নাহারকে তলব করেছিলেন আপিল বিভাগ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ দেওয়া বিচারক কামরুন্নাহারকে গত বছর তলব করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এক মামলায় স্থগিতাদেশ থাকার পরও ধর্ষণের ঘটনায় আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তলব করা হয়েছিল তাকে। যে মামলায় তলব করা হয়েছিল, ওই মামলায় তার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছে আজ। তবে, সর্বোচ্চ আদালত কী আদেশ দিয়েছেন সেটি জানা যায়নি। জামিন নিয়ে কামরুন্নাহারকে যে মামলায় তলব করা হয়েছিল, সেই আবেদনটি ‘রাষ্ট্র বনাম আসলাম সিকদার’হিসেবে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) ১ নম্বর ক্রমিকে ছিল। এ বিষয়ে সোমবার (১৫ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চ আদেশ দেন। আদালতে এদিন রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, আপিল বিভাগ বলেছেন, আদেশ দেওয়া হলো। তবে কী আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পেলে জানা যাবে। বিচারক আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কিনা, তাও আদেশ পেলে বোঝা যাবে। তলব ও মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ধর্ষণ মামলার এক আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গত বছরের ১২ মার্চ তলব করেন আদালত। ওই বছরের ২ এপ্রিল কামরুন্নাহারকে আদালতে হাজির হতে বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তাকে আদালতে হাজির হতে বলা হলেও তখন করোনার (কোভিড-১৯) কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা আর জানা যায়নি। আজ ওই মামলার বিষয়টি কার্যতালিকায় কজলিস্টে শুনানির জন্যে আসে।
২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিল থানায় আসলাম শিকদারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ওই মামলায় ২০১৯ সালের ১৮ জুন হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৫ জুন আপিল বিভাগের চেম্বারজজ আদালত জামিন স্থগিত করেন। এ দিন জামিন স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। আবেদনটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকা এবং আপিল বিভাগের চেম্বার জজের স্থগিতাদেশ থাকার পরও গত বছরের ২ মার্চ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক কামরুন্নাহার তাকে জামিন দেন। সর্বোচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের পরও আসামিকে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আপিল বিভাগের নজরে আনেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল (বর্তমানে মরহুম) অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম। তিনি ওই সময় আদালতকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসামিকে নিম্ন আদালতের জামিন দেওয়াটা আদালত অবমাননার শামিল। এভাবে জামিন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১২ মার্চ আপিল বিভাগসংশ্লিষ্ট বিচারককে ব্যাখ্যা জানাতে আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেন। সেইসঙ্গে আসলাম সিকদারকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে আসলাম সিকদারের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় ওই মামলা করা হয়। মামলায় গত বছরের ১৪ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫–এর বিচারক। রায়ে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসলাম সিকদারকে খালাস দেওয়া হয়। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, ওই রায়ে খালাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে আপিল আবেদন করেছে। হাইকোর্ট আপিল শুনানির জন্য গ্রহণও করেছেন।
রেইনট্রি রায় নিয়ে আলোচনা ও বিচারিক দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার:
মোছা. কামরুন্নাহার ছিলেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক। তিনি রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় ১১ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেওয়া হয়। তবে ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশকে মামলা না নেওয়ার পর্যবেক্ষণ দেওয়া বিচারক কামরুন্নাহারের ফৌজদারি বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রত্যাহারের আদেশ পেয়ে তিনি রোববার (১৪ নভেম্বর) এজলাসে বসেননি। এমন পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন আসে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও জনসাধারণের পক্ষ থেকেও। এরপর গত শনিবার (১৩ নভেম্বর) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছে বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে জন্য একটা চিঠি লিখবেন। এরপর রোববার (১৪ নভেম্বর) সকালে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাইফুর রহমান এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ওই বিচারককে আদালতে বসতে নিষেধ করেন। একই সঙ্গে কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া তাকে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) কামরুন্নাহারকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে রোববার জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে কামরুন্নাহারকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হলো। গত বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক কামরুন্নাহারের আদালত ওই মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনকে খালাস দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, মামলার দুই ভিকটিম আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত। তারা স্বেচ্ছায় হোটেলে গেছেন। সেখানে গিয়ে সুইমিং করেছেন। ঘটনার ৩৮ দিন পর তারা বললেন, ‘আমরা ধর্ষণের শিকার হয়েছি’। অহেতুক তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়া এরপর থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায় তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।
এ বিষয়ে কথা বলেছেন আইন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা। শনিবার (১৩ নভেম্বর) রেইনট্রির আলোচিত মামলায় ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নিতে বিচারিক আদালতের রায়ে একটি সুপারিশ রাখা হয়েছে, এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি (মন্ত্রী আনিসুল হক) বলেন, একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- আমি রায়ের বিষয়বস্তু নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। আমি শুধু বলবো বিচারকের অবজারভেশন, যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অসাংবিধানিক। রায়ে বিচারিক আদালতের পর্যবেক্ষণ দেওয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই বলে রোববার (১৪ নভেম্বর) সাংবাদিকদের জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।