বন উজাড় বন্ধের চুক্তিতে নাম লেখায়নি বাংলাদেশ

0

শাহেদ শফিক॥ ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় হওয়া বন্ধ করতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিশ্বের ১২৪টি দেশ। এই সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে দেশগুলো। তবে এই তালিকায় নাম লেখায়নি বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, বন রক্ষায় সবার (স্বাক্ষর করা দেশ) সঙ্গে বাংলাদেশও একমত। এই মুহূর্তে ওই ঘোষণার সঙ্গে যুক্ত না হলেও বিষয়টি তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন। তবে পরিবেশবাদিরা বলছেন, তালিকায় নাম না থাকাটা হতাশাজনক। এ সংক্রান্ত তহবিল থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। তাছাড়া বিশ্ব পরিমণ্ডলে দেশের যে সুনাম রয়েছে— তাও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের তৃতীয় দিনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল বিশ্বের বনভূমি রক্ষা করা। এতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় পৃথিবীর বনরক্ষায় ঐকমত্যে আসে প্রভাবশালী দেশগুলো। পাশাপাশি এজন্য তহবিলও ঘোষণা করা হয়েছে।
বিশ্বের বৃহত্তম বন আমাজন ধ্বংসের অভিযোগ যে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে, বন রক্ষার উদ্যোগে তারাও একমত হয়ে স্বাক্ষর করেছে। স্বাক্ষর দাতার তালিকায় আছে আরও বেশ কয়েকটি দেশ। সবমিলিয়ে তালিকায় নাম লেখানো দেশগুলোর দখলে আছে পৃথিবীর মোট বনের ৮৫ শতাংশ। কিন্তু সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকাটাকে হতাশাজনক বলছেন পরিবেশবাদিরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন নানাভাবে উজাড় হচ্ছে বনভূমি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার যখন বাংলাদেশ, তখন এটিতে স্বাক্ষর না করাকে হতাশার। বন রক্ষা না করতে পারলে শতকোটি টাকা খরচ করেও জলবায়ুর ক্ষতি রোধ করা যাবে না বলেও মত তাদের। এ বিষয়ে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এটা খুবই হতাশাজনক যে বাংলাদেশে যেখানে জলবায়ু মোকাবেলায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে বিশ্বের কাছে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্রের সাথে একমত হচ্ছে না। এর ফলে এই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করা দেশগুলো ক্ষতিপূরণ পাবে সেটা বাংলাদেশ পাবে না। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে— বাংলাদেশ বন উজাড় বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে না।
এদিকে বাংলাদেশের এমন অবস্থানে উদ্বোগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি অবিলম্বে আন্তর্জাতিক এই ঘোষণার সাথে একাত্মতা প্রকাশের পাশাপাশি এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধে এবং বন রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধে বিশ্বের ১২৪টি দেশের ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের একাত্মতা প্রকাশ না করা চূড়ান্ত হতাশাজনক। বিশেষ করে, ব্রাজিলসহ আফ্রিকার বহুদেশ এই ঘোষণায় যুক্ত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শীর্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাড়া না দেওয়া অবিশ্বাস্য। অথচ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসেবে, বাংলাদেশে বার্ষিক বৈশ্বিক গড় হারের প্রায় দ্বিগুণ বন উজাড় হয়, যা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। শুধু গত ১৭ বছরেই দেশের প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। আর বন বিভাগের হিসেবে, সারাদেশে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে— যার মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি। এমনকি সরকারি-বেসরকারি নানা অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে প্রাকৃতিক সুরক্ষাবলয় হিসেবে পরিচিত সুন্দরবনও এখন হুমকির মুখে। এমন কঠিন বাস্তবতায় বৈশ্বিক এ ঘোষণায় বাংলাদেশের অবিলম্বে সম্পৃক্ত হওয়া অবশ্য কর্তব্য।’ তবে সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, দেশের সংবিধানেই বন রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা আছে। সেই আলোকে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। কাজেই তালিকায় বাংলাদেশ থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে আলোচনা চলছে। বন রক্ষায় ১৪ বিলিয়ন পাউন্ডের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা করা হয়েছে। শিল্পায়ন করে বন রক্ষা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, পরিবেশ রক্ষা করেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ শিল্পায়ন হচ্ছে। শিল্পায়নের জন্য যেন পরিবেশের ক্ষতি না হয় সে বিষয়গুলো আলোচনায় তুলে ধরছে বাংলাদেশ। শুধু প্রাকৃতিক বনভূমি রক্ষা নয়, জলবায়ু মোকাবেলায় শহরগুলোতে সামাজিক বনায়ন বাড়ানোর প্রস্তাবও এসেছে সম্মেলনে। বন ও পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, আমাদের সংবিধানে বন রক্ষায় যে আইন রয়েছে তা অনুযায়ী বন রক্ষা করতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত বন রক্ষা করে চলছি। বরং বিভিন্ন এলাকায় বনের সংখ্যা আরও বাড়ছে। উপকূলীয় বনসহ সামাজিক বনায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি যেহেতু একটি ঘোষণাপত্র আমাদের আরও ভাবার জন্য সময় রয়েছে। আমরা বিষয়টি আরও পর্যালোচনা করে দেখবো।