‘হলুদ’ বাদ দিয়ে ‘সাদা-কালো’ পথ ধরুন

0

ইকতেদার আহমেদ
‘ফোরথ্ এস্টেট’ শব্দটি প্রেস এবং সংবাদমাধ্যম সংশ্লেষে ব্যবহৃত হয়। তিনটি ইউরোপীয় ঐতিহ্যগত ধারণা যাজক, আভিজাত্য ও সাধারণ থেকে ‘ফোরথ এস্টেট’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে। ফোরথ এস্টেট রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও পরোক্ষভাবে সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তারে এটির ভূমিকা রয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। বাধানিষেধের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো হলো- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা। ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা আক্ষরিক অর্থে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা।
মানুষ সামাজিক জীব। এ পৃথিবীতে মানুষের আগমনের পর থেকে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বাস করে আসছে। একজন মানুষের সাথে অপর মানুষের ভাবের বিনিময় কথোপকথনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ কথোপকথন কখনো শালীনতা ও নৈতিকতা বিবর্জিত হওয়া কাম্য নয়। আদিম সমাজে ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আবির্ভূত হওয়ার আগে মানুষ তার নিজস্ব বোধশক্তি দিয়ে শালীনতা বা নৈতিকতা এবং অশালীনতা বা অনৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে নিজেদের কথোপকথন মার্জিত রাখার ক্ষেত্রে সচেষ্ট থেকেছে। আমাদের সংবিধানে একটি একক অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে সীমারেখা দিয়ে নির্দিষ্ট করে দেয়া যায় না। আমাদের সংবিধানেও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কোনো সীমারেখা দেয়া হয়নি। চিন্তা ও বিবেকের বহিঃপ্রকাশ বাক ও ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা ও বিবেকের প্রকাশ না ঘটছে ততক্ষণ পর্যন্ত কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তা শালীনতা বা নৈতিকতার পরিপন্থী কি না। সংবিধানের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা বিষয়ক অনুচ্ছেদটি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় কোনো ধরনের বাধানিষেধ ছাড়াই চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার উল্লেখ রয়েছে। অপর দিকে বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেখা যায় এটি শর্তসাপেক্ষ। আর শর্তগুলো মোতাবেক, একজন নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রভৃতি বিষয়ে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত যেসব বাধানিষেধ রয়েছে তা অতিক্রম না করে। বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অধিকারের প্রয়োগ করতে গিয়ে বিগত এক দশকের অধিক সময় ধরে দেশের সাধারণ জনমানুষ ও সাংবাদিকরা তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর অপপ্রয়োগে নিষ্পেষণ, যন্ত্রণা, হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে কারান্তরীণ, এমনকি মৃত্যুর মুখেও পতিত হয়েছেন। কম্পিউটার ও ডিজিটাল প্লাটফর্মের অভাবনীয় অগ্রগতিতে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন সহজলভ্য হওয়ায় ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ফেসটাইম, বিপ, ইমো, স্কাইপ, মেসেঞ্জার, জুম প্রভৃতির সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব মাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহের আদান-প্রদানের বদৌলতে দেশের বা দেশের বাইরে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা অতিনিমেষে জানার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনার কোনো কোনোটি ক্ষমতাসীনদের ভাবমর্যাদা ও স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় এগুলোর প্রকাশে তারা দারুণভাবে রুষ্ট। আর এর ফলে অনেককেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার অনেকসময় এসব মাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্যের অপব্যাখ্যার মাধ্যমেও অনেককে হয়রানি ও নাজেহাল হতে হয়েছে। অত্যাচার, নিষ্পেষণ, হয়রানি, নাজেহাল, লাঞ্ছনা, কারাভোগ ও মৃত্যুর তালিকায় যেমন দেশের বিশিষ্টজন রয়েছেন অনুরূপ অচেনা অজানা এমন অনেকে রয়েছেন মামলায় বিজড়িত হওয়ার পর যাদের নাম প্রকাশ্যে এসেছে।
সাংবাদিকদের কাছে দেশের জনমানুষ সবসময় সত্য ও বাস্তব বিষয় জানার প্রত্যাশী। দেশের জনমানুষ চায়, দেশের যেকোনো স্থানে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনার প্রকৃত তথ্য যদি তা জনশৃঙ্খলার জন্য হানিকর না হয় সে বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করতে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব অসত্য, অন্যায়, অনিয়ম, অনৈতিকতা, দুর্নীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান হলেও কিছু সাংবাদিক নিজ অসৎ উদ্দেশ্যচরিতার্থে সে দায়িত্ব হতে বিচ্যুত। এরূপ সাংবাদিকরা হলুদ সাংবাদিকতার আবরণে আবদ্ধ। ‘হলুদ সাংবাদিকরা’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন ও রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনে সদা তৎপর। এরা কোনোরূপ গবেষণা বা খোঁজখবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশনে সচেষ্ট। হলুদ সাংবাদিকতার প্রধান উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেকোনোভাবে কাগুজে ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রচার বা দর্শক সংখ্যা বাড়ানো। ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার, সাধারণ ঘটনাকে চাঞ্চল্যকর ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, কেলেঙ্কারির খবর গুরুত্বসহকারে প্রচার, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি হলুদ সাংবাদিকতার পর্যায়ভুক্ত। সাংবাদিকদের বলা হয় সমাজের সবচেয়ে বিবেকবান অংশ। সাংবাদিকরা তাদের লেখনী (কলম) যাকে তরবারি থেকে ধারালো বলে বিবেচিত করা হয়, এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন আচার-অনাচার ও দুঃখ-দুর্দশা সংবাদপত্রে প্রকাশ করে থাকেন, যা পাঠকের মনে কখনো বস্তুগত এবং কখনো অবস্তুগত প্রতিফলন ঘটায়। সাংবাদিকরা সমাজের প্রকৃত সমস্যাবলির ব্যাপারে সচেতন থাকলে তা সুষ্ঠু সমাজ গঠনে সাহায্য করে। অন্য দিকে সাংবাদিকরা যদি সমাজের প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করে অপরের অর্থ দ্বারা বশীভূত হয়ে হলুদ সাংবাদিকতার নামে একপেশে সংবাদ লেখেন বা প্রবন্ধ ছাপেন তা নৈতিক স্খলনের পর্যায়ে পড়ে। সুতরাং হলুদ সাংবাদিকতা দেশের প্রগতি, অগ্রগতি ও যেকোনো বিভাগের সুন্দরভাবে পথ চলার ক্ষেত্রে অন্তরায়। অতএব হলুদ সাংবাদিকতা দ্বারা সাংবাদিকতা পেশাকে বিতর্কিত করা কাম্য নয়। বিগত শতকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সাংবাদিক ফ্রাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যথা- ক. সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলামজুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা; খ. ছবি আর কাল্পনিক নকশার অপরিমিত ব্যবহার; গ. ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণা জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার; ঘ. সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সাথে সাধারণ কমিক্স সংযুক্ত করা হয়; ঙ স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি। সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার ও উইলিয়াম রুডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার বহিঃপ্রকাশে হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম। এই সাংবাদিকদ্বয় তাদের নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অপরের অপেক্ষাকৃত যোগ্য সাংবাদিকদের অধিক বেতনে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগদানের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। একপর্যায়ে ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর খবর পরিবেশন করে তারা পত্রিকার প্রচার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। পুলিৎজারের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও হার্স্টের নিউ ইয়র্ক জার্নালের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য এবং পাঠকদের উত্তেজনা বৃদ্ধি তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের জন্য তাদের নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে থাকেন। প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয় এমন সব দেশের সরকারপ্রধানদের এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে কঠিন, রূঢ়, আক্রমণাত্মক ও বিব্রতকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রশ্নকর্তা সাংবাদিকরা কোনো ধরনের স্তুতি, প্রশংসা, মনোরঞ্জন ব্যতিরেকেই সরাসরি প্রশ্নের অবতারণা করেন। কোনো প্রশ্নকর্তা সাংবাদিক উত্তরদাতার জন্য বিব্রতকর প্রশ্ন করে নাজেহাল বা হয়রানির শিকার হয়েছেন এসব দেশে এমন কোনো নজির নেই। প্রশ্ন যত কঠিন বা রূঢ় বা বিব্রতকর হোক না কেন, উত্তরদাতা বিচলিত না হয়ে যথাসম্ভব নিজেকে সংযত ও স্বাভাবিক রেখে উত্তরদানে সচেষ্ট থাকেন; কিন্তু এর ব্যতিক্রমটি পরিলক্ষিত হয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আইনের শাসন ও স্বাধীন সাংবাদিকতা থেকে দূরে অবস্থানরত দেশগুলোর ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে সরকারপ্রধানের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিগত কয়েক বছর যে ধারায় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে আসছেন তাতে মূল প্রশ্নে যাওয়ার আগে প্রশংসা, স্তুতিমূলক বাক্য ও মনোরঞ্জনে বেশির ভাগ সময় ব্যয় হয়। এ ধরনের প্রশ্ন প্রশ্নকারীকে বিব্রত না করলেও উত্তরদাতা ও দর্শকশ্রোতাদের জন্য বিব্রত হওয়ার কারণ হয়ে দেখা দেয় । সাদার বিপরীত কালো হলেও সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলা হলে সত্যের স্বরূপ উদঘাটিত হয় এবং জনগণ প্রকৃত তথ্য বিষয়ে জ্ঞাত হয়। আর এ কারণেই দেখা যায় প্রকৃত অর্থেই যারা সাংবাদিক তাদের মধ্যে হলুদের একটুও স্পর্শ নেই এবং তাদের পথ হলো সাদা-কালো যে পথ ধরে তারা অন্যায় ও অসত্যের বিপক্ষে এবং সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে ।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক