চেক জালিয়াতি : যশোর শিক্ষা বোর্ডের আড়াই কোটি টাকা লোপাট

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ যশোর শিক্ষা বোর্ডে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। সরকারি কোষাগারে জমার জন্য আয়কর ও ভ্যাট বাবদ দশ হাজার ছত্রিশ টাকার ৯টি চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং এবং শাহী লাল স্টোর নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখার এই চেকগুলো ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এরপর সাংবাদিকরা এ বিষয়ে খোঁজ নিতে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে যান। ওই সময় সেখানে উপস্থিত যশোর শিক্ষাবোর্ড এমপ্লইজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট নানা অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তারই ধারাবাহিকতায় এই চেক জালিয়াতির ঘটনা। নিরপেক্ষ তদন্ত করলে জড়িতদের নাম বেরিয়ে আসবে।
তবে ওই শ্রমিক নেতার ওই অভিযোগের বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোল্লা আমীর হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেক কম্পিউটারে প্রিন্ট করা অবস্থায় দেয়া হয়। সেখানে হাতে লেখার সুযোগ নেই। ধারণা করা হচ্ছে জালিয়াতি করে ভুয়া চেকের মাধ্যমে এসব টাকা আতœসাত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা থানায় জিডি করেছি। গঠন করা হয়েছে ৫ সদস্যর তদন্ত কমিটি। যার প্রধান কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানি। কমিটির রিপোর্ট আসার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।  এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক শিক্ষাবোর্ড শাখার ব্যবস্থাপক এসএম শাহিদুর রেজা জানান, ভেনার্স প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ঢাকার ফকিরাপুল ঠিকানার চেক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ক্লিয়ারিং চেকের মাধ্যমে এসব টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
তবে ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যশোর শাখার ব্যবস্থাপক রিয়াদ হাসান জানিয়েছেন, চেক জালিয়াতির সঙ্গে আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। সোনালী ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্সর ভিত্তিতে চেকের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।’ দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের (দুদক) উপ-পরিচালক মো: নাজমুচ্ছায়াদাত জানান, বিষয়টি আমরা শুনেছি, রোববার সব নথি তলব করা হবে। সরকারের টাকা আতœসাতের সাথে যারাই জড়িত হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যশোর শিক্ষাবোর্ডের ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে আয় ব্যয় বোর্ডের সকল ব্যাংক একাউন্টের স্টেটমেন্টের সাথে মিল করতে গিয়ে দেখা গেছে বোর্ডের ব্যয় একাউন্ট এসটিডি-২৩২৩২৪০০০০০২৪ হিসাব খাতের ৯টি চেক পরিশোধিত হয়েছে। যা বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের চেকে উল্লেখিত টাকার পরিমাণে সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পরিশোধিত টাকার মিল নেই। এ ধরণের অমিল ধরা পড়ায় হিসাব প্রদান শাখার হিসাব রেজিস্ট্রারের সাথে মিলিয়ে দেখা হয়। বোর্ডে সংরক্ষিত মুড়ি বইয়ের ৯টি চেকের তারিখ অনুযায়ী হিসাব শাখায় ব্যয় রেজিস্ট্রারের ব্যয় বিবরণীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য চেকগুলো ইস্যু করা হয়। ইস্যুতকৃত চেকগুলোর বিপরীতে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ সরকারি কোষাগারে অর্থ পরিশোধিত হয়নি। শিক্ষাবোর্ডের ইস্যুকৃত ৯টি চেক জালিয়াতি করে দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছে। এরমধ্যে ২০২০ সালের ৮ জুলাই আয়কর বাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছেন। একই ভাবে ২০২০ সালের ১২ আগস্ট ভ্যাট বাবদ এক হাজার ২০৭ টাকার ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট আয়কর বাবদ ৬০০ টাকা চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে শাহী লাল স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর আয়কর বাবদ ৬৭৮ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। এই চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে শাহী লাল স্টোর। একই বছরের ১৯ নভেম্বর ভ্যাট বাবদ ৬০০ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং। ২০২১ সালের ৬ মে ভ্যাট বাবদ ৯৯৬ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাত করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ২৯ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৭২৫ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ৪২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ৩০ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৮০ টাকার চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর আয়কর বাবদ বোর্ড ৬৫০ টাকার চেক ইস্যু করেছে। এই চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। ভ্যাট ও আয়কর বাবদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ হাজার ২৬ টাকা বাবদ ৯টি চেক ইস্যু করে বোর্ড। ওই চেকগুলো জালিয়াতি করে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। ব্যাংক থেকে পরিশোধিত চেক/অর্থের বিপরীতে প্রতিষ্ঠান দুটি বোর্ডে কোন মালামাল বা সেবা সরবরাহ করেনি।
সূত্র আরও জানান, নিয়মানুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান বোর্ডে মালামাল সরবরাহের লক্ষ্যে বোর্ডের সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত কার্যাদেশ প্রাপ্তির পর কার্যাদেশে উল্লেখিত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্টোরে মালামাল সরবরাহ করে বোর্ডের সচিবের কাছে মালামালের চালান ও বিল ভাউচার দাখিল করবেন। তারপর বোর্ডের সচিব মালামাল বুঝে নেওয়ার জন্য চালান ও বিলের উপর স্টোর কিপারকে উল্লেখ করে স্টোরে প্রেরণ করবেন। স্টোর কিপার ওই চালান এবং বিল ভাউচার সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত স্মারকে কার্যাদেশ অনুযায়ী মালামাল বুঝে নিয়ে বিল প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে বিল ভাউচার হিসাব প্রদান শাখায় প্রেরণ করবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হিসাব প্রদান শাখার কার্যাদেশের মাধ্যমে বিল প্রদান নথি নিরীক্ষা করে দেখা যায় ব্যাংক থেকে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে কোন বিল ভাউচার নথিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ জালিয়াতি চক্র অন্য বিল হতে ভ্যাট ও আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার লক্ষ্যে ইস্যু করা চেকগুলোর মুড়ির নম্বরের এবং তারিখের মিল রেখে চেক জালিয়াতি করেছে বোর্ড তহবিলের টাকা আত্মসাত করেছে।