বাইকের চাকায় চলে সংসার

0

পিয়াস সরকার/ ফাহিমা আক্তার সুমি॥ বাইকের চাকায় চলে তাদের সংসার। চাকা ঘুরলে ঘুরে সংসারের চাকা। আর চাকা থেমে থাকলে সংসারের চাকাও থেমে যায়। এমন বাইকের চাকায় সংসার চালাচ্ছে দেশের শত শত যুবক। শিক্ষিত, বেকার যুবকরা বাইকের চাকায়ই তাদের স্বপ্নের জাল বুনছেন। রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তারা দাবড়ে বেড়ায় রাজপথ থেকে অলি-গলি। বাইক শেয়ারিং। প্রথমে বাস্তবে রূপ দেয় অ্যাপভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর একাধিক প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসা শুরু করে। বেকার যুবকরা অর্থ রোজগারের একটি পথ পায়। অনেকেই নিজের বাইকটিকে অ্যাপযুক্ত করে নেয়। আবার অনেকে অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও শেয়ারিং করে যাচ্ছে। যাত্রী বহন করে কোনো মতে টিকে আছেন জীবনযুদ্ধে। এমনই একজন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাহাত হোসেন। বাইকের চাকায় চলছে তার সংসার।
রাহাত বলেন, আমার বাড়ি সাভারের ভাকুর্তায়। বিএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। আমার পরিবার সচ্ছল ছিল। আমাদের টয়লেট্রিজের পণ্যের পাইকারি দোকান আছে। করোনাকালেও বেশ চলছিলো দোকানটা। কিন্তু হঠাৎ বাবার অসুস্থতা। বেশ কয়েক লাখ টাকা খরচ হয় চিকিৎসায়। এরপর বাবা মারা যান। ব্যবসাটা চালান বড় ভাই। বাইক কেনার জন্য আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই বাইক পছন্দ না হওয়ায় আব্বার ক্যাশ থেকে আরও ৫০ হাজার টাকা চুরি করি। কিনি এই বাইকটা। কিনে আনার পর আব্বাকে বলেছি আব্বা কিছু বলে নাই। এখন এই বাইকটাই সংসারকে টেনে নিচ্ছে। বেলা ১১-১২টার দিকে বের হই। বাড়ি ফিরি রাত ১০টার পর। সারাদিনে খরচ শেষে থাকে হাজার টাকার মতো। রাহাতের মা অসুস্থ। বোন জামাই প্রবাসী। বোনও থাকেন তাদের বাড়িতে। বড় ভাই লেখাপড়ার পাশাপাশি ঝিমিয়ে যাওয়া দোকানটা সামলাচ্ছেন। রাহাত বলেন, বাবার চিকিৎসার জন্য নেয়া প্রায় লাখ টাকা ঋণ এখনো আছে। ভাই আর আমি মিলে সংসার চালানোর পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ করছি।
আরেকজন সজীব আহমেদ। গতকাল গ্রিন রোডে অপেক্ষা করছিলেন যাত্রীর। তিনি বলেন, আমি একটি প্রাইভেটফার্মে চাকরি করতাম। করোনাকালে সেই চাকরি চলে যায়। এরপর আরেকটা চাকরিতে ঢুকেছি। কিন্তু এখানেও বেতন আগের থেকে ১০ হাজার টাকা কম। তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি সময়ে ও ছুটির দিন বাইক নিয়ে বের হই। আমি সদ্য বাবা হয়েছি। খরচ বেড়েছে, কমেছে আয়। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না কি পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের। ধরেন পান্থপথ থেকে গুলশান যাবো। রাস্তায় ২/৩ বার চেক করা হয়। সময় নষ্ট হয়। আর মামলা দেয়া তো অহরহ ঘটনা। করার কিছুই নাই, রাস্তায় অসহায় আমরা। কাগজ সব ঠিক, এরপরও মামলা দেয়া হয়। আর মামলা থেকেও ভয়াবহ মামলা ভীতি। রাজন শিকদার বয়স প্রায় ৫০। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে বাইক চালাতে ঢাকায় আসেন। ১৫/২০ দিন চালিয়ে আবার যান বাড়িতে। আবার আসেন ১০/১২ দিন পর। রাজন বলেন, আমার ছোট একটা মুদি দোকান আছে এলাকায়। সেই দোকানে এখন ছেলে বসে। বাড়তি আয়ের জন্য এক বছর ধরে এভাবে ঢাকা আসা-যাওয়া করি। ঘরে বিয়ের উপযুক্ত দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েই সংসারের বেহাল দশা। দুই মেয়ের বিয়ে দেবো কীভাবে জানি না।
আরেকজন রাইড শেয়ারিং চালক আবু বক্কর বলেন, করোনায় চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছি। বাবা কৃষিকাজ করেন। বয়সের ভারে এখন আর বেশি কাজ করতে পারেন না। সংসারের সব খরচ আমাকেই চালাতে হয়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। করোনার প্রথম ঢেউয়ে চাকরিটা চলে যায়। তারপর গ্রামের বাড়ি নওগাঁয় গিয়ে কয়েকমাস জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছি। এরপর রাইড শেয়ারিং চিন্তা করলাম। ধারদেনা করে একটি বাইক ক্রয় করি। প্রথমে ভালো চললেও এখন রাস্তায় রাস্তায় ভোগান্তি পোহাতে হয়। কোনোমতে পেটেভাতে বেঁচে আছি। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও রাস্তায় দাঁড়ানোর জন্য মামলা খেতে হয়। গুণতে হয় আয়ের চেয়ে বেশি টাকা। এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আরও একটি মামলা খেতে হয়। দুই থেকে তিন হাজার টাকা মামলায় চলে যায়। মামলা দিলে টাকা না গুণে আর কোনো উপায় থাকে না। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতাম। চাকরি হারানোর পর তাদের নিয়ে গ্রামে চলে যাই। কিছুদিন পরে অভাবের কারণে পরিবার বাড়িতে রেখে আবার ঢাকায় চলে আসি। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে ও বাবা-মা আছেন। ছেলেটাকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। এই পেশায় মোটামুটি আয় আছে কিন্তু অত্যাচার বেশি। এগুলো আর ভালো লাগে না। হয়রানি না থাকলে তবুও কিছুদিন এই কাজ করে সংসার চালানো যেতো। সবসময় হতাশায় ভুগতে হয়। প্রতিদিন সব খরচ বাদে আট থেকে নয়শ’ টাকার মতো থাকে। শুধু আবু বক্কর নয়, সরজমিন দেখা যায় রাজধানীর সাইন্সল্যাব, ধানমণ্ডি, ফার্মগেট কাওরান বাজার, শাহবাগে মোটরসাইকেল নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছেন চালকরা। মো. সোহান জানান, গত বছর করোনায় চাকরি হারিয়েছি। বনানীতে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা। সকাল থেকে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। এখনো এক টাকাও আয় হয়নি। রাস্তায় যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে পুলিশ এসে বলে কেন দাঁড়িয়েছি এখানে। পরিবারে মা ছাড়া সবাই আছে। সবাই গ্রামে থাকে। আমার আয় দিয়ে সংসার চলে। এখন এই কাজ করে কোনোমতে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। চাকরির জন্য অনেক জায়গায় আবেদন করা আছে কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া পাচ্ছি না। শাহবাগের মোড়ে অপর এক চালক এমদাদুল জানান, যা ইনকাম করি তাতে মোটামুটি চলে। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। কোনো রকম বেঁচে আছি। তামিম হাসান জানান, একটি সুপার শপে চাকরি করতাম। নিয়মিত বেতন না দেয়ায় ছেড়ে দেই। প্রথম লকডাউনের দিকে বাড়ি চলে যাই। প্রায় আড়াই মাস বাড়িতে ছিলাম। এরপর অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি। তার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ট্রাই করেছি। কোথাও চাকরি হয়নি। অ্যাকাউন্টিংয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছি। এরপর গত বছরের শেষের দিকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়। সেখানেও বেতন নিয়ে সমস্যা। কোনো উপায় না পেয়ে রাইড শেয়ারিংয়ের সিদ্ধান্ত নেই। উবারের সঙ্গে যুক্ত হই। কিছুদিন পরে তাদের কমিশনের কারণে বিরক্ত হয়ে অ্যাপস থেকে বেরিয়ে আসি। এরপর চিন্তা করলাম চুক্তিভিত্তিক চালাবো। এখন তাই করছি। ঢাকা রাইড শেয়ারিং ড্রাইভারস ইউনিয়নের তথ্যমতে বাইক ও কার মিলিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রায় ৪ লাখ লোক রাইড শেয়ারিং করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর শুধুমাত্র রাজধানীতে বাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় ২ লাখ মানুষ। এই সংগঠনের সদ্য সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান বলেন, আমরা হয়রানি কমানোর দাবি জানাই। পাশাপাশি অ্যাপভিত্তিক রাইডগুলোকে এখন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়। আমরা চাই তা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করার। এজন্য আমরা আবেদন জানিয়েছি। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেয়া হলে আমরা আন্দোলনে নামবো।
সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ বলেন, একটা বিষয় দেখেন কোম্পানি কিন্তু সংখ্যাটা জানান না। তারা লুকোচুরি করে। কারণ তারা কি পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে তা জানাতে চায় না। আমরা নিজেরাও সঠিকভাবে বলতে পারবো না। তবে ধারণা রাজধানীতে ২ লাখ বাইক রয়েছে। ৫০ থেকে ৬০ হাজারের মতো কার আছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট মিলিয়ে মোট ৪ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ কমিশন করা হোক। কোনো চালককে যেন মিথ্যা অজুহাতে আইডি বন্ধ করে দিয়ে তাকে কর্মচ্যুত না করা হয়। তবে অপরাধ প্রমাণিত হলে যা ব্যবস্থা গ্রহণ করুক তাতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু নির্ণয় করবেন কীভাবে? আমরা দাবি করি কারগুলোর ভেতরে ও বাইকগুলোর হেলমেটে ক্যামেরা লাগিয়ে দেয়া হোক। এতে আমরা শেয়ারিং ছাড়া রাইডসহ অপরাধ করলেও তা বের হয়ে আসবে। ১০ শতাংশ করার বিষয়ে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এভারেজ একটা শেয়ারে ভাড়া আসে ২০০ টাকা। এ থেকে কোম্পানির সবমিলিয়ে ব্যয় হয় মাত্র ৮ টাকা। প্রচার-প্রচারণায় খরচ হয় ৩ টাকা। ২০০ টাকার রাইডে এখন তারা পাচ্ছে ৫০ টাকা। যা গরিবের পেটে লাথি মারা।