কোথায় বিনিয়োগ করবে মানুষ?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে সরকার। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে যাদের বেশি পরিমাণে টাকা রয়েছে তারা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষ করে এর ফলে মধ্যবিত্তের আয় কমে যাচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা নারীরাও ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। একইভাবে নতুন সিদ্ধান্তে কমবে প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়কারীদের আয়ও। প্রবাসীরাও ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের বিপরীতে মুনাফা কম পাবেন। এ বিষয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বলেছেন, করোনাকালে এমনিতেই অনেক মানুষ কষ্টে আছে। এছাড়া দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প কম। সরকারের এ সিদ্ধান্তে তাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে। রাজধানীর মানিক নগর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী আবু শামা বলেন, পেনশনের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি মুনাফা কমানোর ফলে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভ পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাস শেষে ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে তথা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৪২ কোটি। আগের মাস জুনে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ৫১৭ কোটি। এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি। এ টাকার একটি অংশ ঘুরেফিরে সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে ফেরার কথা। কিন্তু ব্যাংকে সুদের হার ২ বা ৩ শতাংশ। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষ টাকা রাখবে কোথায়?
বিনিয়োগকারীদের অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এখন তারা টাকা রাখবেন কোথায়? কারণ, এতো দিন নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সবচেয়ে বেশি মুনাফা মিলতো সঞ্চয়পত্র থেকেই। সাধারণত, সচেতন মানুষ নিরাপদ হিসেবে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। আর অর্থনীতির সূত্র বলে, ব্যাংকে সুদ যখন কমে যায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে যখন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তখন টাকা যায় শেয়ারবাজারে। আর শেয়ারবাজারে যখন আস্থা হারায় তখন মানুষ উচ্চ সুদে বা দ্বিগুণ, তিনগুণ লাভের আশায় বিভিন্ন লোভে পা দেয়। এর আগে বেশি মুনাফার লোভে ইউনিপেটু, ডেসটিনি, যুবক এমনকি এহসান গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে শেষ পর্যন্ত সর্বস্বান্ত হয়েছেন বেশ কিছু সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের বড় অংশই হয় ব্যাংকে। কিন্তু কোনও কোনও ব্যাংকে আমানতের সুদহার এখন ২ শতাংশে নেমে গেছে। এদিকে ব্যাংকের বাইরে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়। দেশের সঞ্চয়ী মানুষের একটা বড় অংশ সঞ্চয়পত্রে টাকা রেখে সেই মুনাফার টাকায় জীবনধারণ করেন। তাদের অধিকাংশই শেয়ারবাজারে অনেকে ভরসা পান না। সাম্প্রতিক ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতারণার ঘটনা এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ নেই মানুষের।
এ প্রসঙ্গে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ( বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, যেহেতু সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা। তারা এখানে বিনিয়োগ করে জীবন চালায়। এ ধরনের নাগরিকদের স্বার্থ বিবেচনায় মুনাফা না কমালেই ভালো হতো। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে হয়ত অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করবেন। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অনেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মুনাফা থেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সঞ্চয়পত্র ছাড়া আপাতত মানুষের সঞ্চয়ের একটি নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা নেই। এর মুনাফার হার কমানোর ফলে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ কোনও খাতে চলে গেলে তা আরও বিপজ্জনক হবে। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, যারা ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন, তাদের ক্ষেত্রে মুনাফা অপরিবর্তিত থাকবে। আর যারা ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা আগের চেয়ে কম হারে মুনাফা পাবেন। এছাড়া ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদি হিসাব এবং সবচেয়ে বেশি মুনাফার ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের হারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। মুনাফা কমানো হয়েছে গড়ে ১ থেকে ২ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের অধিকাংশই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর নির্ভরশীল। সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে তাদের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়বে। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়ার পর তার ধাক্কা লাগে আমানতের সুদহারেও। কমতে কমতে গত জুলাই শেষে ব্যাংক খাতে আমানতের গড় সুদহার নেমে আসে ৪ শতাংশে। এখন কোনও কোনও ব্যাংকে আমানতের সুদহার ২ শতাংশে নেমে গেছে। অন্যদিকে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকে টাকা রেখে সাধারণ মানুষ আসলে কোনও মুনাফা পান না। বরং টাকার মান কমে। এ অবস্থায় গত আগস্টে ব্যাংকের আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির ওপরে রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এদিকে প্রথমবারের মতো সরকার মুনাফা হারের আলাদা স্তর করেছে। সঞ্চয় স্কিমের স্তর করেছে তিনটি। ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে মুনাফা অপরিবর্তিত থাকবে। ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কমবে ১ শতাংশ। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কমবে ২ শতাংশ। অর্থাৎ বেশি টাকার বিনিয়োগকারীর মুনাফার হার কম। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে সরকার বলছে, সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় বেশি বিনিয়োগের সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো হয়েছে। এতে করে সরকারের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় কিছুটা কমবে। গত গত জুন পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে মানুষের মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।