স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য নয়

0

শওকত মাহমুদ
ইসলাম ব্যক্তির মর্যাদা, প্রতিনিধিত্বমূলক কর্তব্য, বিচার বিভাগের প্রাধান্য, পারস্পরিক পরামর্শের বাধ্যবাধকতা, নেতৃত্বের জবাবদিহি, আখেরাতের জবাবদিহি, আদালতের মাধ্যমে জবাবদিহি, জনগণের কাছে জবাবদিহি, জীবনের নিরাপত্তা, মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা, মালিকানার নিরাপত্তা, ব্যক্তি নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সংরক্ষণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, সমান অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার লাভের অধিকার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অধিকার, সংগঠন ও সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রভৃতি সুনিশ্চিত করেছে। এসবের ব্যত্যয় হলেই তাকে জুলুম বলা হয়। বর্তমান আলোচনায় শুধু মতপ্রকাশের প্রসঙ্গেই যদি আসি, দেখতে পাই মানব জাতির সূচনা থেকেই এ অধিকারের চর্চাই ছিল মূল স্তম্ভ। বিভিন্ন আসমানি কিতাব তথা কুরআন কারিমের মধ্য দিয়ে আল্লাহ নিজের মতপ্রকাশ করেছেন। নবী-রাসূলদের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন। হজরত নুহ আ: যখন তার জাতির লোকদের কাছে একত্ববাদ নিয়ে বলতেন, তখন লোকেরা কান ঢেকে দিত কাপড় দিয়ে, যাতে নবীর মতটি শুনতে না হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘মুক্তধারা’ নাটকে একদল লোক কান-ঢাকা টুপি পরা সম্পর্কে এক ভিন্নমতাবলম্বীর মুখ দিয়ে এমন সংলাপ বলিয়েছেন- ‘জগতটা বাণীময় রে! যেখান দিয়ে শোনা বন্ধ করবি, সেখান দিয়ে মৃত্যুবাণ আসবে।’
আল্লাহর প্রেরিত নবীরা মতপ্রকাশ করতে গিয়ে কত নিগ্রহ সয়েছেন। ইহুদিরা এক দিনে ৩৬ জন নবীকে হত্যা করেছিল। সূরা ইয়াসিনে বর্ণিত তিন নবী ও তাদের মতের পক্ষে এক ব্যক্তিকে তাদের মতের জন্য ওই জাতির লোকেরা হত্যা করেছিল। আল্লাহ এতে এতই অসন্তুষ্ট হন যে, এক বিকট গর্জনে ওই জনপদের সবাইকে নিস্তব্ধ করে দেন। মহানবী সা:-এর জীবনীটা দেখুন। নির্ভীক মতপ্রকাশের দরুন তার ওপর কী জুলুমই না হয়েছে! সবশেষে তাঁর মতই জয়ী হয়েছে। মানুষ কেবল শাসকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাগ্যুদ্ধই করবে না, বরং রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো ও সমস্যাবলি সম্পর্কেও তারা স্বাধীন মত ব্যক্ত করবে। মানুষের অন্যতম প্রধান কর্তব্যই হচ্ছে, তারা সৎ কাজের আদেশ দেবে আর অসৎ কাজে বাধা দেবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া এই গুণ কি সৃষ্টি হতে পারে? খারাপ কাজে বাধা দেয়া মানে তার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করা। না করলে আল্লাহর শাস্তি। সূরা মায়িদাতে বনি ইসরাইলের অধঃপতনের একটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে- এভাবে তারা যেসব গর্হিত কাজ করত তা থেকে একে অন্যকে বারণ করত না (৭৯ আয়াত)। এর আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, মন্দ কাজের পক্ষে মতপ্রকাশ বর্জনীয়। আমাদের আলেম সমাজ কেন যেন শত নির্যাতনের মুখেও এসব বলতে চায় না। কেউ কেউ নির্দয় স্বৈরাচারের সঙ্গী হয়ে গেছে। সূরা নিসার ১৩৫ আয়াতে আল্লাহ বলে রেখেছেন, ‘যদি তোমরা পেঁচাল কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে স্মরণ রেখো তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত।’ বিশ্বনবীর কাছে সাহাবিরা এমন অকপটে মতপ্রকাশ করতে পারতেন, যা ভাবাই যায় না। একবার কোনো এক যুদ্ধে তিনি নির্দেশ দিলেন, অমুক অমুক স্থানে অবস্থান নিতে হবে এবং শিবির স্থাপন করতে হবে। একজন সাহাবি জানতে চাইলেন, এ আদেশ কি আল্লাহর ওহি মারফত না আপনার ব্যক্তিগত অভিমত থেকে? তিনি বললেন, এ আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সাহাবি আরজ করলেন, ‘এই স্থান তো উপযোগী নয়, বরং অমুক অমুক স্থানে অবস্থান নেয়া অধিকতর সুবিধাজনক হবে। মহানবী সেভাবেই ব্যবস্থা নিলেন (শিবলী নোমানী, সিরাতুন্নবী, প্রথম খণ্ড)।
আল্লাহ ও রাসূলদের বাণীর ব্যাপারে যারা সংশয়গ্রস্ত ছিলেন বা মোটেও কান দেননি, তাদের ভিন্নমতের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি নিষেধ করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা। সূরা গাশিয়াহর ২১-২২ আয়াতে নবীজীর এর দাওয়াত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলছেন- ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি তো একজন উপদেশদাতা। তুমি তো ওদের কর্মনিয়ন্ত্রক নও।’ সূরা আনআমে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের পূজা করে তাদের গালমন্দ করো না (আয়াত ১০৮)। ইসলাম সভা-সমাবেশের অধিকার, মান-ইজ্জতের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ধর্ম। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ইসলাম নাগরিকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। সূরা নিসা (১৪৮ আয়াত) বলছে- ‘অশ্লীলভাষী হওয়া আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে তার কথা স্বতন্ত্র।’ অর্থাৎ অশ্লীলতা ও মন্দ কথার প্রচারণা খুবই গর্হিত কাজ। কিন্তু অন্যায়-অবিচার যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, ধৈর্য-সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে যায়, সম্পূর্ণ অপারগ অবস্থায় জবান থেকে মন্দ ও অশ্লীল কথা বেরিয়ে পড়ে, তখন উচ্চতর নৈতিক শিক্ষা সত্তেও আল্লাহর কাছে এই সর্বশেষ অবস্থা ক্ষমাযোগ্য। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- মানুষ যদি অত্যাচারীর অত্যাচার ও জুলুম দেখেও তাকে প্রতিহত না করে তা হলে আল্লাহর ব্যাপক শাস্তি তাদের ওপর নাজিল হবে। (ইসলামে মানবাধিকার/মুহাম্মদ সালাহুদ্দীন/অনুবাদ মুহাম্মদ আবু তাওয়াম/মুহাম্মদ আবু নুসরাত হেলালী) ইসলাম শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকারই দেয়নি, বরং যদি এই প্রতিবাদ সত্য প্রমাণিত হয় তা হলে সে ক্ষেত্রে জালেমের আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করার অধিকারও ইসলামে রয়েছে। এমনকি তাকে অপসারণেরও। বিশ্বের ইতিহাসে এবং রাষ্ট্রতন্ত্রের সর্বধারায়ও এটি স্বীকৃত। আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারীদের আনুগত্য করবে না (সূরা শুআরা : ১৫১ আয়াত)। নবীজীর আহ্বানও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’ অর্থাৎ যে শাসক আল্লাহর অবাধ্য হবে, তার আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাও।
বাংলাদেশে কোথায় আছি
উপমহাদেশে সাংবাদিকতার জন্ম রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও আপন মতপ্রকাশের তাগিদ থেকে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য মোটা দাগে বিস্তৃত হয়েছে জুলুমের প্রতিবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে। আর বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধকারী কালো আইনগুলোও বারবার ছোবল মেরেছে। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদক কবি কাজী নজরুল ইসলাম হচ্ছেন প্রথম গ্রেফতার হওয়া সম্পাদক। ১৯২১ সালের ৩ নভেম্বর ওই পত্রিকায় ‘নিশান-বরদার’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন- ‘আমাদের বিজয় পতাকা তুলে ধরবার জন্য এসো সৈনিক। পতাকার রং হবে লাল… বল আমরা পেছোব না।’ মূলত মতপ্রকাশের শেষ-না-হওয়া-লড়াইয়ে হার-না-মানা সৈনিকই রয়ে গেছেন সাংবাদিক লেখকরা। বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদ, যিনি আইয়ুবের স্বৈরশাসন থেকে বর্তমান অনির্বাচিত নির্দয় স্বৈরাচারী সরকার পর্যন্ত দেখেছেন, খুবই আক্ষেপ করে বলেছেন- ‘অতীত ভোলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন দুষ্কর্মের বন্যায়। অতীতের কালিমার মধ্যেই থেকে যাচ্ছি আমরা। আলো আর আসে না। সূর্যের জন্য এত পথ হাঁটলাম, আমার জীবনেই তো বত্রিশটি বছর, তবু আলোর মুখ দেখলাম না। কেন যে এমন হলো গোপনে মাথা কুটেও তার উত্তর পাই না। বাইরে সাহসী ভাব দেখাই। কারণ সারা জাতি এত দিন সংগ্রাম করেও তার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি, এ কথা বলতেও তো লজ্জা লাগে (একালের বয়ান)।’ হায়রে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের নকলি নবাবী। মিথ্যে সাহসী ভাব দেখিয়ে আমরা চলি। পথিকৃৎ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফয়েজ আহমদ জীবনসায়াহ্নে এসে উচ্চারণ করেছেন- সত্যবাবু মারা গেছেন। সত্যের মৃত্যু সম্পর্কে বলি। ‘আমার দেশ’-এর অসম সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে উচ্চ আদালত তার আদালত অবমাননার অভিযোগ স্বীকার করতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখন এক বিচারপতি ধমকে বলেছিলেন, Truth is no defense (সত্য কোনো রক্ষাকবচ নয়)। অগ্রণী ইসলামী চিন্তাবিদ, যিনি জালেমের কাছে মাথা নত করেননি, সাইয়েদ কুতুব শহীদ তার অসাধারণ তাফসির গ্রন্থ ‘ফি যিলালিল কোরআন’-এ এক ভয়ঙ্কর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই পৃথিবীতে সব থেকে বড় বিপদ হচ্ছে এমন সব লোকের মধ্যে বেঁচে থাকা যারা নিজেদের বা কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো শ্রেণীর মানুষকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করে। এরপর তাদের বাস্তব ও সার্বিক আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী মনে করে। এ ফেতনা জনগণকে বিভিন্ন দল ও মতে বিভক্ত করে ফেলে। কারণ প্রকাশ্যে তারা মানবতা দেখাতে গিয়ে নিজেদের এক জাতি বা মানবগোষ্ঠী বলে প্রকাশ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক দল আরেক দলকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায় এবং কেউ কেউ ক্ষমতায় জেঁকে বসে থাকে এবং সে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য যেকোনো হীনপন্থা গ্রহণ করতেও কসুর করে না। এর প্রধান কারণই হচ্ছে এরা আল্লাহর প্রেরিত বিধানকে থোড়াই কেয়ার করে; বরং কারো কারো মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও অপরের জন্য পতন এবং অকল্যাণ কামনার ভাব বিরাজ করে। যারা ক্ষমতাসীনদের পতনের অপেক্ষায় থাকে এবং পরস্পর অকল্যাণ কামনা করে, তারা উভয়ে এসব মন্দ কামনা-বাসনার কুফল করে এবং এর ফলে না তারা একে অপর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে, না পৃথকভাবে থেকে নিজেদের সুখশান্তি নিয়ে নিজেরা বসবাস করতে পারে। আর না তারা পরস্পর মিলেমিশে বাস করতে পারে। গোটা পৃথিবীর জনগণ আজ ধীর অথচ দীর্ঘস্থায়ী এই কঠিন অনৈক্য তথা অশান্তির আজাবে আবদ্ধ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে।’ এ উপলব্ধি আজকের বাংলাদেশে প্রকট।
গণমাধ্যমের পরিমণ্ডলে পীড়নের ভয়ানক অবস্থা সম্পর্কে পরিসংখ্যান নিজেই লজ্জিত। আগেই বলেছি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সূচকের ক্রমাবনতি কথা। আইন-ঐতিহ্য, সাংবিধানিক অবজ্ঞার মধ্যে হাজারো পত্রিকা নিঃশব্দ খুনের শিকার হয়েছে। চ্যানেল ওয়ান, ইসলামিক টিভি, দিগন্ত টিভি, আমার দেশ বহু দিন ধরে বন্ধ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অপছন্দের পত্রিকা ও সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ৪২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের কিনারা হচ্ছে না। অতিমারী করোনার মধ্যে গত জুলাইয়ে ১০ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার ৬। ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের সংখ্যা ১৪২, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গ্রেফতার ১৩। ভিন্ন মতিদের বেকার করে দেয়া, বিজ্ঞাপন বন্ধ, সরকারি পরিচয়পত্র বাতিল- এসব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিসরে পঞ্চাশ বা ষাট দশকে বাকস্বাধীনতার ওপর চরম পীড়ন শুরু হলে নির্যাতিতরা আন্তর্জাতিক পশুক্লেশ নিবারণ সমিতির চেয়ারপারসন নায়িকা ব্রিজিট বার্দোতের কাছে আহ্বান জানিয়েছিল এই বলে যে, বেড়ালের মিউ মিউ করার, কুকুরের ঘেউ ঘেউ করার অধিকার রয়েছে; আমাদের তাও নেই। দয়া করে আমাদের পশু গণ্য করে কুকুর-বেড়ালের ওই অধিকারটুকু এনে দিন। বাংলাদেশে এখন এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা। ফেসবুকে লাইক বা কমেন্ট নয়, ঘেউ ঘেউ বা মিউ মিউ করা ছাড়াই শুধু যদি শেয়ার করেন, তাতেই জেল হচ্ছে অনেকের। গোপন সংস্থাগুলো সার্বক্ষণিক নজরে রাখে কে সরকার বা সরকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে কী বলছে বা শেয়ার করছে। সাথে সাথেই পুলিশ গিয়ে হাজির।
২০১৪ এর একতরফা, জালিয়াতির ভোটের আগে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের জামিন অযোগ্য ৫৭ ধারা দিয়ে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমন জুলুম করা হয়, যাতে ওই ভোট নিয়ে কেউ যাতে উল্টো বলতে না পারে। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রবর্তন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। এবং যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ সাংবাদিকদের ওপর। আইনমন্ত্রীর আশ্বাস ছিল বিপরীত। পুরো সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল, আটটি ধারার সংশোধন চেয়েছিল। ধুত্তোরি- এই ছিল সরকারের প্রতিক্রিয়া। বলা যায়, ২০২৩ সালের ভোটের আগে আরেক দফা কালো আইন আসবে নিশ্চিত। বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ২০টিরও বেশি আইন ও বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বেশির ভাগই বাক, ব্যক্তি, চিন্তা, বিবেক ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণের জন্য। পক্ষের আইন শুধু তথ্য অধিকার এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন। জালেমের জন্য ঢোড়া সাপ। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের নিশ্চয়তা, প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধসাপেক্ষে ওই সব অধিকারের নিশ্চয়তা। কিন্তু আইনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তিসঙ্গতির সীমারেখা ছাড়িয়ে গেছে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুল মতিনের মতে, (প্রথম আলোর সাক্ষাৎকার) ৩৯ অনুচ্ছেদের এসব নিশ্চয়তা হচ্ছে হজরত মূসা আ:-এর লাঠির মতো, যা অজগর সাপ হয়ে ফেরাউনের জাদুকরদের সাপগুলো খেয়ে ফেলেছিল। এরপর ওই সব জাদুকর ফেরাউনকে না জিজ্ঞেস করেই আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেয়। আমরা তো বড় অজগরকে নিথর দেখছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো কর্মরত অবস্থায় এখন একজন বিচারপতি এই পর্যবেক্ষণ দিতে পারবেন কি? সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী জারি হওয়ার পর মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথমবার এক ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। ৭ক (১) এর খ অনুচ্ছেদ বলছে, এই সংবিধান বা এর কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবে। ৭খ অনুসারে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলিকে সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি গণমাধ্যমের মুখ বন্ধের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার আইনের নির্বিচার প্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ-সংক্রান্ত আইনের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র প্রেস কমিশন গঠিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে; প্রবীণ রাজনীতিবিদ মরহুম আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে এবং শীর্ষ সম্পাদকদের সদস্য রেখে। ওই রিপোর্ট ৩৯ অনুচ্ছেদ বর্ণিত- বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তকে মতপ্রকাশের বাধার ক্ষেত্রে অভিনব শর্ত হিসাবে উল্লেখ করে বলেছিল, এটা বিশ্বের শুধুমাত্র ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে। অন্যত্র নেই। এই শর্তের অপসারণ প্রয়োজন। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এটা এখন অন্তর্ভুক্ত। দুনিয়াকাঁপানো লেখক কার্ল মার্কস জার্মানিতে একটা পত্রিকা বের করতেন। তিনি রাশিয়ার জার শাসকের কড়া সমালোচক ছিলেন। রাশিয়ার রাজা জার্মানির রাজার কাছে কার্ল মার্কস সম্পর্কে এই বলে অভিযোগ আনলেন যে, মার্কসের লেখালেখি দুই সাম্রাজ্যের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারে। দেশ থেকেই মার্কসকে বহিষ্কার করা হলো। অন্য দিকে এখন বাংলাদেশ থেকে ভিন্নমতি সম্পাদক-সাংবাদিকদের স্বেচ্ছা নির্বাসন ব্যাপকভাবে ঘটেছে শুধু নির্যাতন থেকে বাঁচতে। এখন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন-নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের, কণ্ঠরোধের পৈশাচিক আয়োজনে জনগণ কী করবে কিংবা তাদের মতামতের প্রতিনিধিত্বকারী মিডিয়া কী করবে? রাজনৈতিক দলগুলো বলার মতো বলছে না, করার মতো করছে না। মিডিয়ার বেশির ভাগ মালিক শাসকদলীয়। তারা ফ্যাসিবাদকে উপভোগ করছে। গিরগিটির মতো ফুঁ দিয়ে আগুন বাড়াচ্ছে। সভ্যতার ইতিহাসে জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই বৈধ হিসেবে বিবেচিত। সব ধর্মের, সব মতের মানুষই এই অধিকার চায়। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় (১০ এপ্রিল) সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন বিবৃত; তা তো আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার ও অঙ্গীকার। ফ্রান্সের মানবাধিকারের দলিল, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার দলিল অথবা জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মূল বিষয়বস্তুই তাই। সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী যদি মনুষ্যত্বের বর্তমান তীব্র লাঞ্ছনায় যদি রাজনৈতিক বিভাজনের যুক্তিতে কিংবা বাংলাদেশী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের দ্বান্দ্বিক দোহাই দিয়ে আপন আপন ঘরে উদাসীন জড়ত্বের মধ্যে দিন কাটায়, তা হলে বাংলাদেশ এগোবে কিভাবে? জগৎখ্যাত বুদ্ধিজীবী আঁরি বারবুস ও চিন্তাবিদ রোমা রোলাঁ ১৯২৭ সালে ফ্যাসিবাদের বর্বরতা রুখতে বিশ্ববাসীর কাছে ‘মুক্ত মানবাত্মার নিকট আবেদন’ শীর্ষক লিখিত আহ্বানে বলেছিলেন, ‘আমরা সর্বত্র লক্ষ করছি যে, ফ্যাসিবাদের নামে স্বাধীনতার সব বিজয়কে হয় ধ্বংস নতুবা বিপদাপন্ন করা হচ্ছে। সংগঠন গড়ার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতা- যা শত শত বছরের আত্মত্যাগ ও আয়াশে অর্জিত হয়েছে, আজ সেসব কিছুকেই নির্দয়ভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। প্রগতির এই দেউলিয়া অবস্থায় আমরা আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারি না।’ আমাদের উপমহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে গড়ে উঠেছিল ফ্যাসিস্টবিরোধী লড়াই। লেখক-সাংবাদিকরা দুর্বার আন্দোলন দাঁড় করান। ১৯৪২ সালে ঢাকায় সোমেন চন্দকে ফ্যাসিস্টরা হত্যা করলে ভারতবর্ষে এই আন্দোলন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের দ্বিতীয় সম্মেলনে (১৫-১৭ জানুয়ারি, ১৯৪৪) মূল সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরূপে সম্মেলনের কার্যসূচি পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল বসু, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, আবুল মনসুর আহমদ, গোপাল হালদার ও শচীন দেব বর্মণের মতো বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অগ্রগণ্য প্রতিনিধিরা। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাতে বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিজম মানুষের চিন্তা ও সংস্কৃতি জগতের শত্রু। দেশব্যাপী দুঃখ ও বিপদের মধ্যে আর সবার সাথে সাহিত্যিক শিল্পীদেরও কাজ করিবার আছে। ইহা স্মরণ করিয়াই এই সংঘবদ্ধতা। অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত হওয়া সাহিত্যিক ও শিল্পীর স্বধর্ম।’ আবদুল মনসুর আহমদ বলেন, ‘লেখক ও শিল্পী আকাশচারী হইতে পারে না, দেশবাসীর চিন্তা ও কল্যাণবোধই শিল্পীর চিন্তাধারাকে রূপায়িত করিয়া তোলে। ভারতের হিন্দু ও মুসলমানের জীবনাদর্শের এবং ঐতিহাসিক শিক্ষা ফ্যাসিজমের বিরোধী, কাজেই ভারতের লেখক ও শিল্পীদের ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা একটি নেতিবাচক ভাববিলাসিতা নহে। ইহার মধ্যে আমাদের জীবনের যোগ আছে (ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলা সাহিত্যের রূপ-রূপান্তর : একটি সমীক্ষা/সুস্নাত দশ/বাংলা আকাদেমি পত্রিকা-২৫)।’ আবুল মনসুর আহমদ আজকের পৈশাচিক ও বাস্তব ফ্যাসিবাদ দেখে যেতে পারেননি, তিনি এ-ও দেখলেন না, তার পুত্র ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ফ্যাসিবাদের তীব্র আঘাতে প্রায় জবুথবু। শুধু একটি দু’টি কালো আইন নাকচের দাবি করা বা গণমাধ্যম পীড়নকে বন্ধ করার আন্দোলন যথেষ্ট নয়, মানবীয় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এখন জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সমগ্র জনগণের মুক্তির জন্য নামতে হবে। প্রত্যেক নাগরিক যেন আর জুলুমের শিকার না হন। নামতে হবে রাজপথে। মতপ্রকাশের একমাত্র জায়গাই ওটা। নির্বাচনে জালেমরা যদি হেরেও যায়, সমাজে তৈরি হওয়া লাখ লাখ শক্তিধর জালেম থেকে যাবে, রক্ত বীজের ঝাড়ের মতো। তাদের পরিশুদ্ধি ঘটতে পারে জনগণের উত্তাল জাগরণে। দুই বছর ধরে অতিমারী করোনায় এবং সরকারের ব্যর্থতায় দেশ, অর্থনীতি, সমাজজীবন, শিক্ষাজীবন বিধ্বস্ত। মতপ্রকাশের অধিকার আরো বেশি পরাহত। নির্দয় স্বৈরতন্ত্রে গণতন্ত্র ও রাজনীতি ধ্বংসের গোরপ্রান্তে। করোনার সংক্রমণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ফ্যাসিবাদী সরকার। কর্তৃত্ববাদে অতিমারী যায় না। ট্রাম্পের আমেরিকায়, মোদির ভারতে আমরা তা দেখেছি। এই ধ্বংসস্ত‚প থেকে দাঁড়ানোর উপায় একটি- তা হলো সরকারের বিদায়। আর কবে সুযোগ আসবে মজলুমের উঠে দাঁড়াবার? নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয়ার সুযোগ আর নেই। নির্বাচন যন্ত্রে যে মত ঢুকুক না কেন, নৌকার পক্ষেই মতের বিকৃত প্রকাশ ঘটবে। আপন শক্তিতে সম্মিলিত গণজাগরণই একমাত্র ভরসা। তারপর দেশ গড়া এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পালা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দু’বার সামরিক শাসন হঠানোর অনন্য রেকর্ডে ভাস্বর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০১৭ সালের ১০ মে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণাকালে যা বলেছিলেন তাতে আমরা আশাবাদী। ‘মিডিয়া ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ অনুচ্ছেদে তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং গঠনমূলক ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচকের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালনে বিএনপি সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নীতিমালা থাকা দরকার। বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, আইটি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করবে। কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। বিএনপি সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করবে এবং চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার নিশ্চিত করবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রুজুকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে।’ মিথ্যা মামলার ফরমায়েশি রায়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ বন্দী, অবরুদ্ধ। তার জবান কেড়ে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগামীর দেশনায়ক তারেক রহমানের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রচার নিষিদ্ধ করে রেখেছে উচ্চ আদালত। আমাদের প্রত্যাশা বাংলাদেশে আরেকটি প্রেস কমিশন হোক। আইনের পরতে পরতে কালো দাগ অপসৃত হোক, মিডিয়া চালিত হোক সভ্যতার নির্দেশিকায়।
লেখক : জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি। ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক,
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ।