অভিশপ্ত লইসকা বিল, কান্নায় ভারী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাতাস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অভিশপ্ত লইসকা বিল। এ বিলই শুক্রবার কেড়ে নিয়েছে ২২টি তাজা প্রাণ। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা নাড়া দিয়েছে গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর মনে। কান্নায় ভারী এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাতাস। একেকটি লাশ গ্রামে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে আর শুরু হচ্ছে মাতম। চম্পকনগর থেকে নৌকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে যাওয়ার পথে লইসকা বিলে ঘটে এ ঘটনা। আর এ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে বহু পরিবারের স্বপ্ন। দুর্ঘটনার কিছু সময় আগে বড় বোন মরিয়ম জানতে চেয়েছিলো কোথায় আছোস।
এরপরই বিলের কয়েকটি ছবি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয় ছোট বোন তাসফিয়া মিম। ছবি পাঠানোর ৫ মিনিট পরই বিলের পানিতে হারিয়ে গেল চিরতরে তাসফিয়া। চম্পকনগরে ফুফু মিনুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো সে। ফুফাতো বোন খাদিজা এসে নিয়ে গিয়েছিলো গত ২২শে আগস্ট। বেড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে হাসিখুশি অবস্থাতে চড়ে বসেছিলো নৌকায়। আর মিনিট ১৫ নৌকা চললে পৌঁছেও যেত শহরে, নিজের বাসায়। কিন্তু সেটি আর হয়নি। মিম শহরের দাতিয়ারা এলাকার মোবারক মিয়ার মেয়ে। তার ৫ সন্তানের মধ্যে মিম ছিল তৃতীয়। শহরের নিয়াজ মুহম্মদ হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তো সে। মোবারক মিয়া জানান, বেড়াতে যেতে দিতে রাজি ছিলাম না। বলেছিলাম গাড়ি করে নিয়ে যাবো পরে। কিন্তু আমার অসম্মতির পরও ভাগ্নি জোর করেই তাকে নিয়ে যায়। নৌকায় মিমের সঙ্গে ছিল ফুফাতো বোন খাদিজাও। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সে। তবে খাদিজার চাচাতো ভাইয়ের এক মেয়ে শিশু মাইদা (৫) মারা যায়। শনিবার ফজর নামাজের পর দাতিয়ারা ওয়াপদা মসজিদ প্রাঙ্গণে মিমের নামাজে জানাজা হয়। পরে গ্রামের বাড়ি আখাউড়ার ষোলঘরে দাফন করা হয়।
বিয়ের এক সপ্তাহ পেরুনোর আগেই লাশ হলো সুমা: গত ২০শে আগস্ট বিজয়নগরের জহিরুলের সঙ্গে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সুমার। হাতের মেহেদির রঙ মুছে যাওয়ার আগেই গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মুছে গেল সুমার জীবনের রঙ। বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লইসকা বিলে নৌকা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সে। শনিবার সকালে শারমিন আক্তার সুমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে শোকের মাতম। সুমা ছিলেন ওই গ্রামের মৃত জারু মিয়ার একমাত্র মেয়ে। সুমাদের বাড়িতে ঢোকার আগেই দূর থেকে কানে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। সুমার একমাত্র ভাই ও মায়ের আহাজারিতে এলাকার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কাঁদছিলেন সুমার মামা আশিক মিয়াও। তিনি জানান, মাত্র সাতদিন আগে তার ভাগ্নিকে বিজয়নগর উপজেলার ভিটিদাউদপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. জহিরুল ইসলামের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় বাজারে মিষ্টির কারিগর হিসেবে কাজ করতেন জহিরুল। নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে নৌকায় করে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলেন জহিরুল। সুমার ভাসুর আমির হামজা বলেন, নৌ দুর্ঘটনায় তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তারা হতবাক হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থলে এসে সুমার নিথর মরদেহ উদ্ধারের দৃশ্য দেখে তাদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, সুমা আর নেই।
ডাক্তার দেখাতে গিয়ে লাশ হলেন মা-মেয়ে: স্ত্রী ফরিদা আক্তার (৪০) ও মেয়ে মোসাম্মৎ মুন্নি (৮)কে বাড়ির পাশের নৌকাঘাট থেকে বিকালে নৌকায় তুলে দেন জজ মিয়া। রাতে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পরদিন সকালে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগেই রাতে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তারা। শনিবার দুপুরে বাড়ির পাশে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে তাদের। নিহতদের বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়েকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন জজ মিয়া। তার বাড়ি বিজয়নগর উপজেলার চম্পকনগর ইউনিয়নের গেড়ারগাঁও গ্রামে। শুক্রবার বিকাল সোয়া ৫টায় লইসকা বিলে বালুবাহী নৌকার সঙ্গে সংঘর্ষে যাত্রীবোঝাই নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে ফরিদা ও মুন্নি (৮) রয়েছেন। ফরিদার স্বামী জজ মিয়া বলেন, আমার স্ত্রীর কোমরে ব্যথা। শনিবার সকালে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। আমি নিজে তাদেরকে নৌকায় তুলে দিয়েছিলাম। রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এক আত্মীয়র বাসায় থেকে সকালে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী ছিল। এ কারণেই এটি ডুবেছে। নৌকা ডুবে গেড়ারগাঁও গ্রামের আরও দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন- মৃত মালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬২) ও আব্দুল হাসিমের স্ত্রী কমলা বেগম (৬৫)। মায়ের জন্য বিলাপ করতে করতে মঞ্জু বেগমের মেয়ে মৌসুমি আক্তার বলেন, আমার নানু অসুস্থ, সে জন্য আমার চাচি কমলাকে নিয়ে নানুর বাড়ি যাচ্ছিল মা। ভাতার জন্য কয়েকদিন আগে মা ছবি তুলেছিলেন। সেই আমার কাছে দিয়ে বলেছিলেন বাবার ছবির সঙ্গে এই ছবিটা বাঁধিয়ে রাখার জন্য। আমি তখন বুঝতে পারিনি আমার মা এভাবে ছবি হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে নৌকার যাত্রী হয়েছিলেন সাহেরা বেগম। গেদু মিয়ার স্ত্রী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। গেরারগাঁও গ্রামে তার ঘরে গিয়ে দেখা যায় শয্যাশায়ী সাহেরা। মুখে কথা নেই। কীভাবে কি হলো তার কিছুই বলতে পারছেন না। আরেকটি নৌকা তাদের নৌকাকে বাড়ি দিয়েছে সেটিই বললেন। জীবন বাঁচলো কীভাবে তাও বলতে পারেন না। তার সঙ্গে নৌকার যাত্রী হয়েছিলেন আর যারা তারা সবাই মারা গেছেন। নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হওয়া শিশু নাশরার (৩) মরদেহ উদ্ধার হয়েছে অবশেষে। শনিবার সকাল পৌনে ১০টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুুবুরিরা নৌকাডুবির স্থল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে। নিহত নাশরা জেলা শহরের পৈরতলা এলাকার হারিছ মিয়ার মেয়ে। শুক্রবার নৌকাডুবির পর থেকেই তার সন্ধান পেতে পাগলপারা ছিলেন স্বজনরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম জানান, নৌকাডুবির ঘটনায় শিশু নাশরা নিখোঁজ ছিল। তাকে উদ্ধারের জন্য শনিবার সকাল থেকে আবার উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। পরে পৌনে ১০টায় নাশরার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নাশরার চাচা মাসুদ মিয়া জানান, শুক্রবার সকালে নাশরা তার চাচা ফারুক মিয়ার শ্বশুরবাড়ি বিজয়নগর উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে বেড়াতে যায়। বিকালে নৌকায় করে বাড়ি ফিরছিল তারা। ফারুক ট্রলারের ছাদে এবং নাশরা ও তার চাচি কাজল বেগম ট্রলারের ভেতরে ছিল। ট্রলারডুবিতে আমার ভাবি কাজল বেগম মারা গেছেন। ফারুক সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও নাশরাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২২জনের মৃত্যু, শেষ হয়নি উদ্ধার অভিযান: লইস্কার বিলে নৌকাডুবিতে ২২জন মারা গেছেন। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শুক্রবার বিকালে বালুবাহী নৌকার ধাক্কায় যাত্রীবাহী নৌকাটি উল্টে পানিতে তলিয়ে যায়। শনিবার বিকাল পর্যন্ত নৌকাটি উদ্ধার হয়নি। তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রুহুল আমিন জানান- শনিবার সারা দিন তল্লাশি করে আর কোনো মরদেহ পাওয়া যায়নি। ডুবুরিদল বারবারই নৌকার ভেতরে ঢুকেছে। চশমা, মানিব্যাগ, চেইন ইত্যাদি পাওয়া গেছে। ডুবুরিদল আমাদেরকে জানিয়েছে ভেতরে আর কিছু নেই। তারপরও আমরা ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধার করবো। ফলে আমাদের উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত হয়নি। আগামীকাল সকালে আমরা নৌকাটি উদ্ধার করবো। তাছাড়া কেউ নিখোঁজ আছে কিনা সে ব্যাপারেও আমরা এলাকায় মাইকিং করেছি। কিন্তু কারো কাছ থেকে নিখোঁজ থাকার তখ্য পাইনি। এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় ৭ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার পর গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটিও কাজ শুরু করেছে।
নিহত ২২: নিহতরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিলোকূট গ্রামের আব্দুল্লাহর মেয়ে তাক্‌ওয়া (৮), চম্পকনগর গ্রামের জহিরুল হক ভূঁইয়ার ছেলে মামুন ভূঁইয়া (২০), গেরারগাঁও গ্রামের মৃত কালু মিয়ার স্ত্রী মঞ্জু বেগম (৬০), একই গ্রামের জজ মিয়ার স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০) ও তার মেয়ে মুন্নি (৬), গেরারগাঁও গ্রামের মৃত আব্দুল হাসেমের স্ত্রী কমলা বেগম, নূরপুর গ্রামের মৃত আব্দুল রাজ্জাকের স্ত্রী মিনারা বেগম, আদমপুর গ্রামের অখিল বিশ্বাসের স্ত্রী অঞ্জলী বিশ্বাস (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার পৈরতলা গ্রামের আবু সাঈদের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫), একই উপজেলার সাদেকপুর গ্রামের ফুয়াদ হোসেনের ছেলে তানভীর (৮), নরসিংসার গ্রামের জামাল মিয়ার ছেলে সাজিম (৭), ভাটপাড়া গ্রামের জারু মিয়ার মেয়ে শারমিন (১৮), উত্তর পৈরতলা গ্রামের ফারুক মিয়ার স্ত্রী কাজলী বেগম, পৌর এলাকার দাতিয়ারা গ্রামের মোবারক মিয়ার মেয়ে তাসফিয়া মীম (১২), ময়মনসিংহ জেলার খোকন মিয়ার স্ত্রী ঝর্ণা বেগম (৫৫), আদমপুর গ্রামের পরিমল বিশ্বাসের মেয়ে তিথিবা বিশ্বাস (২), মনিপুর গ্রামের হাজী আব্দুল বারীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৫৮), বাদেহারিয়া গ্রামের কামাল হোসেনের মেয়ে মাইদা আক্তার (৬), ময়মনসিংহ জেলার গোপালপুর গ্রামের শাওনের মেয়ে সাজিদ (৩), বড় পুকুরপাড়ের মো. সোলায়মান মিয়ার স্ত্রী রুবিনা আক্তার, সোনাবর্ষিপাড়ার আব্দুল বারী ভূঁইয়ার স্ত্রী মোসাম্মৎ নুসরাত জাহান, উত্তর পৈরতলা গ্রামের হারিজ মিয়ার মেয়ে নাফসা আক্তার (৩)।
হত্যা মামলা: লইস্কার বিলে নৌকাডুবির ঘটনায় বিজয়নগর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। বিজয়নগরের গেরারগাঁও গ্রামের মো. সেলিম মিয়া বাদী হয়ে শনিবার বিজয়নগর থানায় এ মামলা করেন। ২৮০/৩০৪/৩৩৭/৩৩৮/৪২৭/৪৩৭ পেনাল কোড তৎসহ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ এর ৭০ ধারায় এ মামলা দায়ের করা হয়। এই মামলার ৫ আসামিকে ঘটনার পর শুক্রবার অভিযান চালিয়ে আটক করে পুলিশ। একই সঙ্গে বালুবাহী ২টি নৌকা আটক করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হচ্ছে- সরাইল পানিশ্বরের জমির মিয়া (৩৩), মো. রাসেল (২২), খোকন মিয়া (২২), মো. সোলায়মান (৬৪), বিজয়নগর পত্তনের মিস্টু মিয়াকে (৬৭)।পুলিশ জানায়, ঘটনায় জড়িত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নৌ-দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি। ১০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করবে তারা। শনিবার দুপুরে চম্পকনগর নৌকা ঘাটে প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় লোকজন এবং ঘাট পরিচালনায় জড়িতদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. রুহুল আমিন। এ সময় কমিটির অন্য দুই সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হোসেন রেজা, ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। শুক্রবার নৌ-দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে।