শিগগিরই কি কাবুলের পতন ঘটছে তালেবানের হাতে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর অনেকটাই পাল্টে যায় বৈশ্বিক রাজনীতির চিত্রপট। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু, চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, অভিবাসনসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।
২০২১ সালের এপ্রিলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ৯/১১-এর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার কথা সব মার্কিন সেনার। সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই নড়েচড়ে বসে সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান। তারা একে একে দখলে নিতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চল। এখন শহর দখল নিয়ে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে তালেবানরা। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পুরো আফগানিস্তান দখলে নিতে হয়ত আর বেশি সময় লাগবে না তালেবানের। বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে এ শঙ্কার কথা উঠে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের যুদ্ধের অবসানের কারণে হয়তো শান্তি ফিরবে, আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এমনটা ভাবলেও তার আর ন্যূনতম সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মত, পরিস্থিতি যেভাবে গড়াচ্ছে, তাতে তালেবানরা ক্ষমতা দখলে নিয়ে নিলে আগের ৬ বছরের শাসনের ধারাবাহিকতায় কট্টর শরিয়া আইনে পিষ্ট করবে আফগানদের।
সাবেক সোভিয়েত আমলে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নয় বছর লড়াই করে আফগান স্বাধীনতাকামীরা। ‘মুজাহিদিন’ নামে স্বাধীনতাকামীদের একটি অংশ ছিল তালেবানরাও। ১৯৭৮ সালে এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়া থেকে লড়াইয়ের শুরু হয়। অভ্যুত্থান ঘটাতে সমাজতান্ত্রিক নেতাদের মদদ দিয়েছিল তখনকার সোভিয়েত সরকার। ১৯৭৯ সাল থেকে সোভিয়েত উপনিবেশের বিরুদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে মুজাহিদিনরা। এই বিপ্লবে মুজাহিদিনদের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৯ সালে আফগান ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যায় সোভিয়েত সেনারা। নেতৃত্ব সংকটের মুখে পড়ে আফগানিস্তান। ১৯৯২ সালে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লড়াইয়ে নামে খোদ মুজাহিদিন কমান্ডাররাই। তবে গৃহযুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকায় তালেবান অবতীর্ণ হয় ১৯৯৪ সালে। তৎকালীন তালেবান যোদ্ধাদের বেশিরভাগই শিক্ষা গ্রহণ করে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের আফগান সীমান্ত এলাকার রক্ষণশীল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। ১৯৯৬ সালে রাজধানী কাবুল দখল করে নেয় তালেবান। বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে অতীষ্ঠ আফগান জনতাও স্বাভাবিকভাবেই নতুন জীবনের আশায় স্বাগত জানায় তালেবান যোদ্ধাদের। কিন্তু তারা কাবুল স্কয়ারে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলায় আফগানিস্তানের শেষ বামপন্থি প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহ আহমাদজাইকে। এরপর আফগানিস্তানকে ইসলামিক আমিরাত ঘোষণা করে সংগঠনটি। চালু হয় তাদের কট্টর শরিয়াহ আইন।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তান আফগানিস্তানের শাসক দল হিসেবে তালেবানকে স্বীকৃতিও দেয়। যদিও তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শুরুর দিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তবে ধর্মীয় রীতির নামে নিষিদ্ধ ছিল গান শোনা, টেলিভিশন দেখাসহ সব ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা। ১০ বছরের কোনো মেয়ে স্কুলে যেতে পারবে না বলেও ফতোয়া জারি করে তারা। খেলাধুলাও নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোরভাবে। শুধু পুরুষরাই খেলাধুলায় অংশ নিতে পারতো, কিন্তু তাদের রক্ষণশীল পোশাক পরে খেলতে হতো এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় বিরতি বাধ্যতামূলক ছিল। তালেবানের শাসনামলে এসব কঠোর বিধিনিষেধ কেউ না মানলে তাকে প্রকাশ্যে পেটানো হতো বা কারাদণ্ড দেয়া হতো। ১৯৯৯ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ। ৯/১১-এর হামলার পর আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকা আল-কায়েদা নেতা সৌদি নাগরিক ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেটি প্রত্যাখ্যান করে তালেবান। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সেনা অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের জোটবদ্ধ বিমান হামলার মুখে কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান। গত ২০ বছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে প্রাণ গেছে ৪০ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষের। নিহত হয়েছে আফগান সেনা ও পুলিশের কমপক্ষে ৬৪ হাজার সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম এই যুদ্ধ আর অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে আমেরিকান সরকারের খরচ হয় প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার।
ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান নামে একটি স্বঘোষিত সমান্তরাল রাষ্ট্র কায়েম করে তালেবান। নিজস্ব একটি সাদা পতাকা আছে তাদের। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে নিজেদের ছায়া সরকারের প্রশাসনকে নেতৃত্ব দিতে ছায়া গভর্নরও নিয়োগ দেয় গোষ্ঠীটি। তালেবান প্রধান একটি পরিষদে নেতৃত্ব দেন। পরিষদটি অর্থ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ ১২টির বেশি কমিশন দেখভালের দায়িত্ব পালন করে। তাদের নিজস্ব আদালত ব্যবস্থাও আছে। সদস্য ও জাতিসংঘের একটি কমিটির তথ্য অনুযায়ী, তালেবানের এই ছায়া সরকারের বার্ষিক আয় প্রায় দেড়শ’ কোটি ডলার। ২০১১ সালে কাতারের দোহায় তালেবানের একাংশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। ২০১৩ সালে দোহায় তালেবানের একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নেতৃত্বে বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে প্রথমবার আনুষ্ঠানিক ও সরাসরি আলোচনায় বসে তালেবান। তবে সমাধান হয়নি। মার্কিন সেনাবাহিনী আফগান ছাড়ার প্রস্তুতির সময় অনেকেই যা আশঙ্কা করেন, তার চেয়েও অনেক দ্রুতগতিতে তালেবান আফগানিস্তান দখল করছে। আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিশনের অধিনায়ক জেনারেল অস্টিন মিলার গত জুনে বলেন, ‘দেশটি এক চরম নৈরাজ্যকর গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যেতে পারে।’ ওই মাসেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক পর্যালোচনায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই হয়তো আফগান সরকারের পতন ঘটতে পারে।