টিকা বাণিজ্যে অভিযুক্ত ‘হুইপ পোষ্য’ বরখাস্ত মামলা না হওয়ায় উদ্বেগ, ক্ষোভ ও অসন্তোষ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ টিকা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ‘হুইপ পোষ্য’ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসাইনকে অবশেষে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।এদিকে, ‘হুইপ পোষ্যেরা’ এই অপবাণিজ্যে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হবার পর প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা। এদের কেউ কেউ এখন গা এড়িয়েও চলছেন।
অন্যদিকে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ায় চাঞ্চল্যকর এই করোনা টিকা বাণিজ্য নিয়ে দাপ্তরিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ঢিমেতালে অবস্থায় উদ্বেগ-অসন্তোষ দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ ও সচেতন নাগরিক প্রতিনিধিদের মধ্যে।
টিকা কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ সরকারি অনুমতি ছাড়াই স্থানান্তর ও প্রয়োগের নামে লোপাট, মজুদদারি কিংবা বাণিজ্যের অভিযোগে এখনো মামলা না হওয়ায় উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নাগরিক সমাজ। মামলা প্রসঙ্গে অবশ্য দায়িত্বশীলরা বলছেন ভিন্ন কথা।
সোমবার করোনার টিকা কেলেঙ্কারি নিয়ে সৃষ্ট অভিযোগে তদন্ত কমিটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিচালক বরাবর তাদের রিপোর্ট প্রদান করেন। কমিটি রাতেই সেই রিপোর্ট স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বরাবর কুরিয়ার করেন এবং মঙ্গলবার সকালে মেইলযোগে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয় বলেও সরকার সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজ সন্ধ্যায় সর্বশেষ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত, চট্টগ্রাম থেকে প্রেরিত তদন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পাননি এবং মেইল পাওয়ার বিষয়টিও অবগত নন বলে জানান।
শুক্র ও শনিবার চট্টগ্রামের পটিয়ার হুলাইন ইউনিয়নে হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি লাগোয়া অস্থায়ী ক্যাম্পে অনুমতিহীন টিকা প্রদান করা হয়। এই টিকা প্রদান উপলক্ষে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হুইপের সম্মতিতে ব্যানার সাঁটানো হয় বিভিন্ন স্থানে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কোন এমপি সরকারি টিকা নিয়ে দলীয় কর্মসূচি না করলেও ‘হুইপ পোষ্যদের’ এমন আয়োজনে এলাকায় নানা প্রশ্ন ওঠে। টিকাদান কর্মসূচি পরিদর্শন করেন হুইপ নিজেই। তার ভাই মহব্বত নিজেই টিকা পুশ করেন। এমন ছবিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই অবৈধ টিকা প্রদান প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবর যায়। আর এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে খবর প্রকাশ হলে শুরু হয় তোলপাড়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডা. অজয় দাস এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ২৬শ টিকা প্রদানের জন্য রেজিস্ট্রেশন কার্ড হস্তান্তর করেন অভিযুক্ত রবিউল। তবে এর মধ্যে মাত্র ২১৮টি রেজিস্ট্রেশন কার্ড এর বৈধতা খুঁজে পায় তদন্ত কমিটি, এমনটি জানায় নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।
ঘটনার পরপরই এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে সরকারি টিকাদান প্রক্রিয়ায় অনুমতিহীন ও অস্বচ্ছতাসহ নানা ব্যত্যয়ের কথা স্বীকার করেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ। কিন্তু তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরে এই উপজেলা কর্মকর্তা নানাজনের হুমকি-ধমকিতে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন! এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে নারাজ তিনি। এড়িয়ে চলছেন সংবাদমাধ্যমের ফোন।
তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের পর চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বিও দোষীদের কোনভাবেই ছাড় দেয়া হবে না বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু গা এড়িয়েই যেন চলছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রথম দফাতেই মুঠোফোনে রেসপন্স করলেও টানা চারদিন অন্তত ১৫ বার ফোন করেও চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ারের কোন রেসপন্স মেলেনি। তার কাছে জমা হওয়া তদন্ত রিপোর্টের বিষয়েও তিনি মুখ খুলছেন না সংবাদমাধ্যমের কাছে।
কর্তাদের কেন এই নীরবতা?
আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে আরও কিছু ভয়াবহ তথ্য। করোনা নিয়ে বাণিজ্যের আরো একটি ভয়াবহ ঘটনা প্রায় ছয় মাস আগে ঘটলেও সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক অভিযোগ পেয়েও নিরব ছিলেন। তখনকার নীরবতাই পরবর্তীতে এখনকার ‘হুইপ পোষ্যদের’ টিকা বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে বলে মনে করছেন বোদ্ধামহল।
কারো কারো অভিমত, হয়তো হুইপ বাহিনীর চাপের মুখেই নিরব রয়েছেন এ বিভাগীয় কর্তা! নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন হুইপ ‘পোষ্য ও ঘনিষ্ঠরা’। তাদের দাবি, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কারণেই ‘হুইপ পোষ্যদের’ এই টিকা বাণিজ্যের খবরটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাতে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
জীবন নিয়ে খেলা ঠিক নয় : আকতার কবির
চাঞ্চল্যকর এই টিকা বাণিজ্য প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির বলেন, যেখানে হুইপ ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা চাপে থাকবেন, এটি অস্বাভাবিক নয়। তবে টিকা প্রদান নিয়ে সরকারের স্বচ্ছতার প্রতি মানুষের যাতে আস্থা থাকে, সেজন্য চাপ মুক্ত পরিবেশে দৃষ্টান্তমূলক আইনি পদক্ষেপ দরকার।
তিনি বলেন, ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা এই টিকাদান প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতায় যুক্ত হয়েছেন। খোদ হুইপের ভাই নিজে অবৈধভাবে টিকা পুশ করেছেন; একথা সরকারের অন্য অর্গানগুলোর না জানার কথা নয়। জীবন নিয়ে খেলা ঠিক নয়। সবকিছুতে কম্প্রোমাইজ আশা করা যায় না।
কেন হুইপের ভাইকে টিকা পুশ করতে হবে : ডা. মাহফুজুর রহমান
চট্টগ্রামের প্রবীণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অসংখ্য নাগরিক আন্দোলনের নেতা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, যেখানে এমপি-হুইপের লোক জড়িত, সেখানে স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ায় যে কোনো তদন্ত এগোবে; এটি বর্তমান রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ায় আশা করা যায় না। এটি অভিযুক্তদের দোষ নয়, রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ারই দোষ। পটিয়ায় ১৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও টিকা প্রক্রিয়ায় কেন হুইপের ভাইকে টিকা পুশ করতে হবে?
এমন বিস্ময়ভরা প্রশ্ন রাখেন এই নাগরিক সংগঠক। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা দিয়ে দ্বিতীয় ডোজের কোন সুযোগ না রাখা, এমন রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
মামলা নয় কেন?
টিকা বাণিজ্যের অভিযোগে গঠিত তদন্তে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ উঠে আসলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট কোন কর্মকর্তা কেন এখনো আইনগত ব্যবস্থা নিলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বোদ্ধাদের মাঝে।
তাদের ধারণা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিষয়ে ফৌজদারি মামলা না হলে কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক কর্তৃক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না হলে পরবর্তীতে দেশজুড়ে অন্য প্রভাবশালী কিংবা এমপি-মন্ত্রীদের এলাকায়ও এমন অভিন্ন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
সিভিল সার্জন যা বললেন
কেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না- এই প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমি এখনো দেখিনি। ওই রিপোর্টে আদৌ কি কি আছে, তা না জেনে আইনগত প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাতো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানেন। তাকে দিয়ে কেন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলো না? এমন প্রশ্নে সিভিল সার্জন বলেন, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা উঠে আসলে নিশ্চয়ই সে বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মামলার সিদ্ধান্ত হবে আইনি পরামর্শেই : মহাপরিচালক
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাস্থ্য ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অভিযুক্ত রবিউলকে সাময়িক সাসপেন্ডের সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ায় যাবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের আইনজীবীর মতামত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মহাপরিচালক এও বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আগে কখনও আসেনি। এমন ঘটনাও ঘটেনি কখনো। তাই আইনগত মতামত নেয়া হচ্ছে। সাধারণত এমন অভিযোগ পেলে অতীতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালে মামলা হতো। কিন্তু এখন এর পাশাপাশি দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে মামলা হবে কিনা, সেটি আইনজীবীর পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ফিরে দেখা
হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর সমর্থিত ছাত্রলীগ নেতা দাবিদার টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসাইনের ‘টিকা বাণিজ্য’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় গত শুক্রবার থেকেই। রেজিস্ট্রেশনহীন এবং বিধিবহির্ভূতভাবে অর্থের বিনিময়ে প্রথমেই ৭শ টিকা প্রদানের অভিযোগ উঠে।
এই অভিযোগ সর্বপ্রথম বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশ পেলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। এবং এই নিয়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। পরবর্তীতে দেখা যায়, ৭শ নয়, ২৬শ টিকা প্রদান করা হয় বলে রবিউল তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকারোক্তি দেন। খোদ হুইপ সামশুলের নিজের ইউনিয়ন শোভনদন্ডীতে ঘটেছে এই ঘটনা। যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অসন্তোষ দেখা দেয়।
এ ঘটনায় তিন সদস্যের গঠিত তদন্ত কমিটিকে দুই দিনের সময় দেয়া হয়। তদন্ত কমিটি তাদের যে রিপোর্ট প্রদান করে; তাতে টিকা প্রদান প্রক্রিয়া সরকারি অনুমোদন না নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট উঠে আসে। এছাড়া তদন্ত কমিটি দেখতে পায় যে, উপজেলা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআই টিকা সংরক্ষণাগারের ওই টিকা প্রদান প্রক্রিয়া সময়কালের সিসিটিভি ফুটেজ উধাও হয়ে গেছে। টিকা প্রদান প্রক্রিয়ায় বৈধতা থাকলে সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করা হতো না বলেও মনে করছে সচেতন মহল। তদন্ত কমিটি জানতে পারে, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় টিকা বহনের জন্য যে কোল্ড বক্স থাকা প্রয়োজন, তা ছাড়াই উপজেলার ওই সংরক্ষণাগার থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্যাম্পটিতে টিকা স্থানান্তর করা হয়েছিল, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকি তৈরি করে।
দেশজুড়ে যখন টিকা নিয়ে সংকট-উৎকণ্ঠা, তখন সরকারি বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্থ নিয়ে এমন টিকা প্রদানের ঘটনায় এলাকাবাসীর মনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে।