যেভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ জয়যাত্রা ফাউন্ডেশন ও জয়যাত্রা টিভির ব্যানারেই বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি এবং অনুদান সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জয়যাত্রা টিভির প্রতিনিধি নিয়োগের নামে চাঁদাবাজি করতেন হেলেনা। প্রতিনিধিদের বেতন দেয়া তো দূরের কথা উল্টো টাকা না পাঠালে প্রতিনিধিদের নিউজ প্রচার হতো না। শুধু দেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশেও জয়যাত্রার প্রতিনিধি ছিল, তাদের সবার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হতো।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে পাঁচটি গার্মেন্ট ও নগরীর অভিজাত এলাকায় অন্তত ১৬টি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদিকে তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মানিলন্ডারিং, বিদেশে অর্থ পাচারসহ হেলেনা জাহাঙ্গীরের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোনো রকম স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে কি না সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নামবে সংস্থাটি। এছাড়া মাদক দ্রব্য আইনে গুলশান থানায় করা মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ।
গত কয়েক মাস আগে জয়যাত্রা টিভির ভোলা প্রতিনিধি তুহিনের সাথে প্রধান কার্যালয়ের একজন নারী কর্মকর্তার কথোপকথন ভাইরাল হয়। এতে শোনা যায়, জয়যাত্রা টিভির প্রধান কার্যালয়ের ওই নারী কর্মকর্তা বলছেন, টাকা না পাঠালে কোনো সংবাদ প্রকাশ হবে না। টাকা না দিতে পারলে আপনাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নেয়া হবে। অভিযোগ রয়েছে, সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়ার নামে ২৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হতো।
জানা গেছে, জয়যাত্রা টিভির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের জন্য সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে একটি গ্রুপ ছিল। ওই গ্রুপে বিকাশ নম্বর দিয়ে প্রতিনিধিদের টাকা পাঠাতে বারবার তাগিদ দেয়া হতো। কেউ চাঁদা দিতে অপারগ হলে তাকে বাদ দিয়ে নতুন প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া হতো।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশন প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন যোগদান করেন। দীর্ঘদিন কাজ করার পর ২০-২৫ জনকে ছাড়া বাকি সবাইকে বেতন না দিয়েই ছাঁটাই করেন হেলেনা। প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কার্ডের বিনিময়ে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশেও জয়যাত্রার প্রতিনিধি ছিল, তাদের সবার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতেন তিনি। দেশে-বিদেশে জয়যাত্রা টেলিভিশনের যত প্রতিনিধি রয়েছে, তা দেশের অন্য কোনো স্যাটেলাইট টেলিভিশনের নেই বলে দাবিও করেন হেলেনা।
তিনি বলেন, হেলেনার বাসা এবং অফিস থেকে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রাজধানীতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের সর্বমোট ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে পাঁচটি, গুলশান ৩৬ নম্বর সড়কের পাঁচটি, গুলশান ২ নম্বরের ৮৬ নম্বর সড়কের ৭/বি নম্বর বাড়িতে ৮ হাজার ফুটের একটি ফ্ল্যাট, গুলশান এভিনিউতে একটি, গুলশান নিকেতনে একটি, মিরপুর ১১ নম্বরের ৬ নম্বর রোডে একটি ও কাজীপাড়ায় একটি ফ্ল্যাট। এর বাইরে তিনি মোট পাঁচটি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক।
এগুলো হলো- মিরপুর ১১ নম্বরের নিউ কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিট, নারায়ণগঞ্জের জয় অটো গার্মেন্ট, জেসি এমব্রয়ডারি, প্যাক কনসার্ন ও হুমায়রা স্টিকার। এ ছাড়া অনেক ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশ থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। অনুদান সংগ্রহে ব্ল্যাকমেলিং ছিল হেলেনার অন্যতম একটি কৌশল। কেবল জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের ব্যানারেই তিনি বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি এবং অনুদান সংগ্রহ করেছেন। জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক টাকা এনেছেন তিনি। এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হেলেনা জাহাঙ্গীর।
হেলেনা দেশের ১২টি অভিজাত ক্লাবের সদস্য। সেগুলো হলো- গুলশান ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাস ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, ঢাকা বোর্ড ক্লাব, গুলশান সোসাইটি ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গুলশান জগার সোসাইটি, ফিল্ম ক্লাব, গুলশান হেলথ ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, ঢাকা রাইফেলস ক্লাব ও ওয়ার্ড ট্র্যাভেলস ক্লাব। হেলেনার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সাথে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। একটা সময় রাজধানীর একটি অভিজাত ক্লাবে চিয়ার গার্ল হিসেবে কাজ করেছেন হেলেনা।
জানা গেছে, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আমলযোগ্য তথ্য পেলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তা অনুসন্ধান করে দেখবে। দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান সাংবাদিকদের বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের যে বিষয়গুলো এসেছে সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে। তার সম্পদ সংক্রান্ত যেসব তথ্য আসছে সেটা দুদকের অংশ হবে, যেহেতু অবৈধ সম্পদের বিষয়টি দুদক অনুসন্ধান করে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আমলযোগ্য তথ্য পেলেই দুদক অনুসন্ধান শুরু করবে।
এদিকে মাদক দ্রব্য আইনে গুলশান থানায় করা মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এ রিমান্ড আবেদন করেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ শাহানুর রহমান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলার রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করার দিন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে তার গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডের হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসভবনে অভিযান শুরু করে রথ্যাব। দীর্ঘ চার ঘণ্টা অভিযান শেষে রাত ১২টার দিকে তাকে আটক করে রথ্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলশান থানায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে তিনি রিমান্ডে রয়েছেন।