কাকের প্রযুক্তি জ্ঞান

    0

    লোকসমাজ ডেস্ক॥ কাক। মানুষের অত্যন্ত কাছের পাখি। মানুষের নানান গঞ্জনা, অপবাদ নিয়েও মানুষের ধারে কাছেই থাকে। বলা হয়ে থাকে, বাপের ভাই কাকা, ভালোবাসা, সন্মানের পাত্র হলেও কাকের কাকা ভালোবাসা, কদর পায় না।
    পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাখি আমাদের ছেড়ে চলে যায়। মানুষের ধমক সয়ে, পুরনো আবাস থেকে বিতাড়িত হয়েও এই কাক রয়েছে মানুষের আশেপাশেই। থাকবে না কেনো? সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই তো ওরা আমাদের সঙ্গে আছে।
    পৃথিবী সেবার প্রবল বন্যায় ডুবে যায়। কোথাও ডাঙ্গার চিহ্ন নেই। সবাই আশ্রয় নেয় নূহ (আ.) নৌকায়। ওই সময় যাকে শুকনো ভূমির খোঁজে পাঠানো হয়েছিলো, সে ছিলো এই বিশ্বস্ত এই কাক।
    সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্যের প্রতীক?
    অন্যদেশে কাক নিয়েও বিজ্ঞানীদের গবেষণা হয়। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে সন্মান পায়। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে কাক নিয়ে নানান রকম কুসংস্কার আজও রয়ে গেছে। কোথাও যাবার সময় ঘরের চালে কিংবা শুকনো ডালে এই কাক বসে থাকতে দেখলে যাত্রা হয়ে যায় নাস্তি বা অনভিপ্রেত। মানে এ সময় কোথাও গেলে অমঙ্গল হয়। বহুকাল থেকেই এদেশে এমন অন্ধবিশ্বাস চলে আসছে। আজও অনেকে এই কুসংস্কার মেনে চলে। ঘরের চালে কোনো কাক যদি ডাকে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়-অজানা অমঙ্গলের আশঙ্কায়।
    অথচ এর পেছনে কোনোরূপ বৈজ্ঞানিক বা যৌত্তিক কারণ নেই। কয়েক বছর আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক একটি পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ তীব্র স্বরে এক কাক কা কা করে ডাকতে ডাকতে তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। কেমন অস্বস্তি লাগে সাংবাদিকের। তিনি গাড়ির গতি কমিয়ে রাস্তার এক পাশে সরে যান। ঠিক সেই মুহূর্তে রং সাইড দিয়ে হাঁ হাঁ করে দৈত্যের মতো আসে এক বিশাল ট্রাক। যদি রাস্তা ছেড়ে সরে না দাঁড়াতেন, নির্ঘাৎ চাপা পড়তেন ট্রাকের নিচে। ভদ্রলোক এখনও বলেন, ‘সেদিন তার জীবন বাঁচিয়েছিলো ওই কাক।’
    ক্ষমতাধর পাখি
    সাধারণ কাকের চেয়ে জাতে বড় কাকের নাম দাঁড় কাক। একে অনেকে লিজেন্ডারি বার্ড বা কিংবদন্তিরর পাখি বলে অভিহিত করে থাকে। কারো কারো কাছে এ পাখি দুর্ভাগ্যের প্রতীকও বটে। কানাডার ভ্যাংকুভার আইল্যান্ডের টনি হান্টের কাছে দাঁড় কাক মানেই সবকিছু। তিনি বলেন, আমার কাছে দাঁড় কাক হলো পরিবারের আলো। দাঁড় কাককে আমরা মেনে চলি আমাদের পূর্বসুরি হিসেবে। এই পাখি প্রচণ্ড ক্ষমতাধারী এক সত্ত্বা। যে কোনো সময় যে কোনো কিছুর রূপ ধারণ করতে পারে। এই কাকের শক্তির কথা আমরা প্রচার করি আমাদের নাচ-গানে।
    সাহসী শিকারী
    কুচকুচে কালো রঙের তিন থেকে চার পাউন্ড ওজনের কিছু দাঁড় কাকের মেলে ধরা ডানা হয়ে থাকে কমপক্ষে চারফুট। এদের তিন ইঞ্চি লম্বা ঠোঁট দারুণ শক্ত হয়। এরা অত্যন্ত সাহসী। ঈগলের মুখ থেকে খাবার কেড়ে নেয়ার সাহসও দেখায় এরা। পাখিদের মধ্যে কাকরাই সম্ভবত সবচেয়ে পেটুক। এরা কী না খায়? পোকা-মাকড়, কীট পতঙ্গ, শস্যদানা, পচা-গলা প্রাণীর লাশ থেকে শুরু করে বাগে পেলে সদ্যোজাত ভেড়া শাবকও এরা মেরে খেয়ে ফেলে। অন্য পাখির মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নিতে কাকদের জুড়ি নেই। কোনো কোনো কাক ঠোঁটে বাদাম নিয়ে, পাথরে ঠুকে তার ছাল ছাড়িয়েও খেয়ে থাকে।
    জ্ঞানী পাখি
    শুধু সাহসী নয়। কাক যথেষ্ট চতুর পাখি। এদের বুদ্ধির জন্যেই হয়তো ঈশপের গল্পে কাককে জ্ঞানী পাখি হিসেবে দেখানো হয়েছে। পাখি বিজ্ঞানীরাও একবাক্যে স্বীকার করেছেন, কাক যথেষ্ট বুদ্ধিমান। রুক্ষ স্বভাবের জন্য কাকের সঙ্গে অন্য পাখিদের কারোরই সদ্ভাব নেই। এমনকি এরা নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া বাঁধায়।
    তবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জ্ঞানটি ওদের বড়ই টনটনে। যেমন, কোথাও একটা লাশ দেখতে পেলো। কিন্তু লাশের গায়ে ঠোঁট বসানোর সাধ্যি তাদের নেই। তখন কি করে? জোরে জোরে ডাকতে থাকে র্ককশ গলায়। তাদের ডাক আকর্ষণ করে নেকড়েদের। কাকের ডাক শুনে নেকড়েরা চলে আসে লাশের কাছে। কাটা ছেড়া করে লাশ। তারপর চলে এক সঙ্গে ভোজন পর্ব।
    আবাস-নিবাস
    শহরের বহুতল ভবনের কার্নিশেই বসবাস করে কাক। এছাড়া গাছেও বাসা বাঁধে এরা। খড়কুটো, লতাপাতা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের সুবিধামত আস্তানা তৈরি করে নেয়। শুধু গাছ বা ভবন নয়। পাহাড় চূঁড়াতেও অনেক কাকের বাসা দেখা যায়। কাক এক সঙ্গে তিন থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। মেয়ে কাক সপ্তাহ তিনেক তা দেয়। ওই সময় তার সঙ্গী ব্যস্ত থাকে খাবার জোগাড়ের কাজে। ডিম ফুটে বেরুনোর সাত সপ্তাহের মাথায় বাচ্চারা উড়তে শেখে।
    মাস কয়েক পরে বাচ্চারা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তবে বেশির ভাগ বাচ্চাই পেঁচা, শকুন বা অন্য কাকের খোরাক হয়ে থাকে। বাবা-মা পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে ব্যর্থ হলে না খেয়েই মরে অনেক বাচ্চা। যুক্তরাষ্ট্রের মরুভূমিতেও কাকের সংখ্যা প্রচুর। মরুভূমির বিরল কচ্ছপদের এই কাক খেয়ে সাবাড় করছে বলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষকরা ওখানকার কাক মেরে ফেলার চিন্তা করছে। নিকারাগুয়া থেকে শুরু করে হাই আর্কটিকের তুন্দ্রা অঞ্চলেও প্রচুর কাক দেখা যায়। প্রচণ্ড শীত সহ্য করে ওই সব অঞ্চলে অল্প কিছু কাক আজও টিকে রয়েছে।
    কাকের প্রযুক্তি জ্ঞান
    গবেষকরা লক্ষ্য করেন, জাপানের কাক জাপানের শিল্প-সংস্কৃতি আর প্রযুক্তি দেখে দেখে আপন মনে শিখেছে। প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন হয়ে গেছে। বয়সে নবীন কাকগুলো নিজ থেকে তাড়িত হয়েই প্রযুক্তি শিখেছে। জাপানি কাকের এই বিজ্ঞান সংস্কৃতি অনুসরণ ততোটা যথাযত না হলেও বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, ‘জাপানি কাক উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পন্ন।’ কাকদের বাদাম খাবার টেকনোলজি, ধরনটা অন্তত সেকথাই বলে দেয়।
    জাপানি কাক বাদাম খেতে গাড়ি ব্যবহার করে। কাকগুলো ঠোঁটে করে বাদাম এনে সড়কের মধ্যে ফেলে দেয়। তারপর বসে থাকে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি ও ল্যাম্প পোস্টের উপর। সবুজ বাতি জ্বলে, গাড়ি চলে। চলন্ত চাকায় বাদাম পিষ্ট হয়। যখন ট্রাফিক লাইট বদলে লাল হয়ে যায়, তখন কাকেরা ঝুপ করে উড়ে এসে খোসামুক্ত বাদাম খেয়ে ফেলে। খুব কম সংখ্যক কাকই এটা ভুল করতে করতে শিখে। বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা মানুষরা নির্দিষ্ট কতিপয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পেরেছি মাত্র। প্রাণীদের মধ্যে কাক আমাদের নগর সভ্যতা সংস্কৃতির বেশি কাছের।’ এই কাক আধুনিককালের মানুষের মতো ততোটা আধুনিক না হতে পারলেও প্রযুক্তি জ্ঞান রপ্ত করে প্রায় কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হতে চলেছে।