সাতক্ষীরায় নয় মাসে ছয় শিশু হত্যা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সাতক্ষীরায় বেড়েছে শিশু হত্যা। গতবছর অক্টোবর মাস থেকে চলতি জুলাই মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সাতক্ষীরায় অন্তত ছয়টি শিশু বা নবজাতক হত্যার শিকার হয়েছে। এছাড়াও রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় জীবিত উদ্ধার করা হয় একটি শিশুকে। নিহত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশই কন্যা। স্থানীয়দের ধারণা, বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক, কুসংস্কার, দারিদ্র্য ও বিচার না হওয়া শিশু হত্যার মূল কারণ।
গত ১৩ জুলাই মঙ্গলবার আশাশুনি উপজেলার কুল্যা ইউনিয়নের গুনাকরকাটি ব্রিজের ওপর থেকে একটি শিশুকে ছুড়ে ফেলা হয় প্রায় ৪০ ফুট নিচে। শিশুটিকে জীবিত উদ্ধার করলেও তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের কারণে রক্তক্ষরণ হয়। তাকে ভর্তি করা হয় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে পাঁচ ঘণ্টা পর নবজাতকটি মারা যায়। ঘটনার সাথে জড়িতদের সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া গেলেও এখনও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগের দিন শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জে পারশেখালী গ্রামের একটি পুকুর থেকে একমাস বয়সী একটি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওইদিন দুপুরে শিশুটির মা আফরোজা খাতুন ঘুমিয়ে পড়লে তাকে কে বা কারা পুকুরে ফেলে দেয় বলে জানানো হয়। পুকুর থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হলেও ঘটনার কোনো ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
এর আগে চলতি বছরের ১ এপ্রিল কলারোয়ার লাঙ্গলঝাড়ায় সন্তানের ওপর যৌন নির্যাতনের বিচার না পেয়ে দুই ছেলে-মেয়েকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন মাহফুজা খাতুন (৩২) নামে এক নারী। নিহত দুই শিশু হলো, মাহফুজ (৯) ও মোহনা (৫)। এঘটনায় মামলা করা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো আসামি গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২ জুন তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামে চতুর্থ সন্তান মেয়ে হওয়ায় স্বামী ভর্ৎসনা করলে আট দিন বয়সী বাচ্চাকে পুকুরে ফেলে হত্যা করা হয়। হত্যার অভিযোগে পুলিশ গর্ভধারিণীকে আটক করলে তিনি অভিযোগ স্বীকার করেন বলে পুলিশ জানায়।
২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর সদর উপজেলার হাওয়ালখালীতে অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা একটি শিশুকে হত্যা করে বাবা-মা। ১৫ দিন বয়সী ওই শিশুর লাশ বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় শিশুটির বাবা-মাকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা শিশুটিকে হত্যার দায় স্বীকার করে বলে পুলিশের ভাষ্য।
এ ছাড়া ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কালিগঞ্জ উপজেলার গোলখালী এলাকার রাস্তার পাশে একটি ব্যাগের মধ্যে থেকে একটি শিশুটিকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। গোলখালী এলাকার মাছচাষি ইসরাইল বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার ও পঞ্চানন মণ্ডল মাছের ঘেরে যাওয়ার পথে গোলখালী মহাশ্মশান থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে আবর্জনাযুক্ত জায়গায় একটি কাপড়ে মোড়ানো ব্যাগের ভেতর থেকে ওই নবজাতককে উদ্ধার করেন। তখনই তারা ছেলে শিশুটিকে প্রথমে কালিগঞ্জ সার্জিক্যাল ক্লিনিকে, পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
ডাক্তারের ভাষ্য, আবর্জনা থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুটির জন্ম ৩-৪ ঘণ্টা আগে। এই ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শিশুটিকে দত্তক নেওয়ার জন্য যোগাযোগ শুরু করেন। ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৯ জন লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন শিশুটিকে নিজের কাছে পেতে।
সামগ্রিক বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অ্যাডভোকেট ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, করোনার কারণে মানুষ অনেকটা ঘরবন্দি। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। সে কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। আবার সঠিক তদন্ত না হওয়া এবং দৃষ্টান্তমূলক শস্তি না হওয়ায়ও এসব হত্যার ঘটনা বাড়ছে।
তিনি এসব ঘটনায় সুনির্দিষ্ট মামলার মাধ্যমে সঠিক বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কোনো অবিবাহিত মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা আইন তুলে নেন নিজেদের হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা আর তার সন্তানকে খুন হতে হয়। ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন, তারা পশ্চিমা সিনেমা দেখছে। কখনো কখনো তারা সামাজিক অবস্থা ভুলে উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কিন্তু পরিবার যখন বিষয়টি জানতে পারছে, ততদিনে হয়তো মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে।
তিনি বলছেন, কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের কারণেও হত্যার শিকার হচ্ছে শিশুরা। বিশেষ করে কন্যাশিশুরা কুসংস্কারের বলি হচ্ছে।
সব মিলিয়ে সাতক্ষীরায় শিশু হত্যার ঘটনাগুলো সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষ এসব ঘটনায় স্তম্ভিত। [খবর: সূবর্ণভূমি]।