ঝিনাইদহে বিশ্বের সবচেয়ে প্রবীণতম ব্যক্তি! ১১৩ বছর বয়সেও তারা প্রাণবন্ত

0

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ॥ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখা দেশের সবচে প্রবীণ ও বয়স্ক মানুষ এখন ঝিনাইদহে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই দুই বিশ্ব যুদ্ধের নানা স্মৃতি এখনো তাদের হৃদয়পটে ভেসে ওঠে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে তাদের দু’জনার বয়স ১১৩ বছর। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই দুই বয়স্ক ব্যক্তির বসবাস আবার একই ইউনিয়নে। এরা হলেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের পরমানন্দপুর গ্রামের শমসের আলীর ছেলে কারী মো. আরেফ আলী ওরফে আরব এবং একই ইউনিয়নের কুলবাড়িয়া গ্রামের শের আলী মিয়া হাওলাদার। তার পিতার নাম মৃত আমির আলী বক্স। আরব আলী ও শের আলী মিয়া উভয়ই ৭ প্রজন্মকে দেখছেন। দুই পরিবারের পক্ষ থেকে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করা হয়েছে তাদের পিতাই বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ।
গুগল ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বর্তমান বয়স্ক মানুষ হিসেবে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ড রেকর্ডসে নাম উঠেছে এমিলিও ফ্লোরেস মার্কেজ। তিনি ক্যারিবীয় দ্বীপ পুর্য়েতো রিকোর বাসিন্দা। এমিলিও ফ্লোরেস জন্ম গ্রহণ করেছেন ১৯০৮ সালের ৮ আগষ্ট। সেই হিসেবে ১১৩ বছর পুরণ হতে এমিলিও ফ্লোরেসের এখনো প্রায় এক মাস বাকী। এদিক থেকে ঝিনাইদহের প্রবীণতম আরব আলীর জন্ম ১৯০৮ সালের ১০ জুন (জাতীয় পরিচয়পত্র নং ২৩৯৭৪২৯১৬৪)। তিনি তার বয়স ইতিমধ্যে ১১৩ বছর পার করেছেন। এছাড়া শের আলী মিয়ার জন্ম ১৯০৮ সালের ১৭ জুলাই (জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৪৪১১৯৫৮৩৯৪৮৭০)। তিনিও পুর্য়েতো রিকোর বাসিন্দা এমিলিও ফ্লোরেসের আগেই ১১৩ বছর পার করবেন। বিশ্ব গণমাধ্যমের বদৌলতে এমিলিও ফ্লোরেস নিজের নাম বিশ্বের বয়স্ক মানুষ হিসেবে গিনেজ বুকে লেখাতে পারলেও ঝিনাইদহের আরব আলী ও শের আলী মিয়ার প্রমাণ থাকার পরও বিশ্বের বয়স্ক মানুষের খেতাবটি চাপা পড়ে গেছে। আরব আলীর ছোট ছেলে আফজাল হোসেন জানান, ১১৩ বছর বয়সেও তার পিতা প্রাণবন্ত ও ফুরফুরে মেজাজে। ৭/৮ বছর আরব আলী ভাত খাওয়া কম করে দিয়েছেন। এখন ফল-মূল ও চা বিস্কুট খান। নিজের কাজ নিজেই করেন। এখনো চলাফেরা করতে পারেন। নিয়মিত নামাজ ও জিকির নিয়ে মশগুল থাকেন বাড়িতে। আরব আলীর বড় ছেলের বয়স এখন ৮৪ বছর বলে জানান ছোট ভাই আফজাল হোসেন।
স্থানীয় ইউপি মেম্বর হাজী জালাল উদ্দীন (৬৯) জানান, এক সময় তাদের গ্রামে মসজিদ ছিল না। পাশের গ্রাম কুতুবপুরে নামাজ পড়তো মানুষ। আরব আলী নিজেই গ্রামে মসজিদ তৈরি করেন। মানুষকে শুদ্ধভাবে সূরা কিরাত শিক্ষা দেন। আরব আলী জানান, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা তার মনে আছে। সে সময় তার ভালো বুদ্ধি। তবে ছেলেদের দাবি তার পিতার বয়স ভোটার আইডিতে কম করে লেখা হয়েছে। তার পিতার বয়স ১২৯ হবে, যোগ করেন ছোট ছেলে আফজাল হোসেন।
এদিকে ঝিনাইদহের আরেক বয়স্ক মানুষ শের আলী মিয়ার ছেলে শহিদুল ইসলাম জানান, তার পিতা আগের চেয়ে কম চলাফেরা করতে পারেন। হুইল চেয়ারে বসে সব কিছু করেন। খাওয়া দাওয়া আগের মতোই আছে। এখনো নিজে ওজু করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন শের আলী হাওলাদার। জীবনে কোনো অসুখ বিসুখ তাকে স্পর্শ করেনি। জীবন সয়াহ্নে এসেও তিনি এক প্রাণবন্ত মানুষ। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন শের আলী মিয়া সবে মাত্র কৈশর থেকে যৌবনে পা রেখেছে বলে তিনি নিজেই দাবি করেন। শের আলীর দেওয়া এই তথ্য সঠিক হলে তিনিই হবেন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী পুরুষ। নিজের জন্ম সাল মনে না থাকলেও শের আলী জানালেন, শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার রাহাপাড়া গ্রামে তারা বসবাস করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ভারত বর্ষ থেকে ব্রিটিশরা যখন সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে, তখন শের আলী ও তার বড় মামা আমজাদ আলী সরদার যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সৈন্যদলে নাম লেখান। সে সময় তারা তাকে একটি সার্টিফিকেটও দেন, যেটি তার ছেলেরা হারিয়ে ফেলেছেন। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তার মা-বাবাসহ বাড়ির সবাই কান্নাকাটি শুরু করেন। যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক করে ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন জোট ফরমান জারি করলে শের আলী মিয়া ও তার বড় মামা তখন যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে যান ভারতের বনগাঁর কাঠালিয়া গ্রামে। পরবর্তীতে সপরিবারে ভারতে বসবাস শুরু করেন। ভারত থেকে তিনি প্রায় শরীয়তপুরের রাহাপাড়া গ্রামে আসা যাওয়া করতেন। আনুমানিক ২০/২২ বছর বয়সে তিনি পাশ্ববর্তী নলতা গ্রামের করম আলী খুনকারের মেয়ে আছিয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথম পক্ষের এক কন্যা সন্তান হওয়ার পর স্ত্রীর আর কোনো সন্তান হবে না জানতে পেরে তিনি নলতা গ্রামের তমিজ উদ্দীন মাঝির কন্যা রুপভান বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষে ৫ ছেলে ও ১ মেয়ে। ১৯৬৮ সালে ছোট স্ত্রী রুপভান ও ১৯৯৯ সালে বড় স্ত্রী আছিয়া খাতুন ইন্তিকাল করেন।
শের আলী মিয়ার ভাষ্যমতে, ১৯৪৬ সালে ভারতে পাঞ্জাবে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সম্পত্তি বিনিময় করে তিনি ৫ ভাই ও পিতা মাতার সাথে চলে আসেন যশোরের চৌগাছা উপজেলার ভাদড়া গ্রামে। ভাদড়া গ্রামে এসে দেখেন মুসলিমদের নামাজ পড়ার কোনো মসজিদ নেই। ১০/১৫ ঘর মানুষের বেশির ভাগ মুসলিম হিন্দু রীতি অনুসরণ করেন। এ সব দেখে তিনি নিজের ইমান আকিদা রক্ষা করতে চলে আসেন ঝিনাইদহের কুলবাড়িয়া গ্রামে।
এলাকার চেয়ারম্যান খুরশিদ আলম জানান, তার ইউনিয়নে দুজন বয়স্ক মানুষের বসবাস। এতে তিনি খুবই গর্বিত। তারা এখনো সুস্থ আছেন। শরীরে তাদের কোনো রোগ নেই। তিনি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত করে এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সবচে বয়স্ক মানুষকে নির্বাচিত করে নতুন ভাবে রেকর্ড তালিকাভুক্ত করার দাবি জানান।