গৃহহীনের ঘর ভাঙছে কার দোষে

0

দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বিনামূল্যে ঘর বানিয়ে দেওয়ার প্রকল্প বর্তমান সরকারের একটি জনমুখী কর্মসূচি হিসেবে বহুল প্রশংসিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে ৯ লাখ ঘর বানিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। খাসজমিতে সরকারের বানিয়ে দেওয়া দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরগুলোর সামনে একটি বারান্দা, একটি টয়লেট, একটি রান্নাঘর এবং একটি খোলা জায়গা রয়েছে। পাশাপাশি এই প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবারগুলো বিদ্যুৎসুবিধা এবং সুপেয় পানির নিশ্চয়তাও পাবে। একটি ঘর শুধু একটি আশ্রয়স্থল নয়, যাদের জমি বা বাড়ি কিছুই ছিল না এমন একটি ঘর তাদের জন্য আত্মমর্যাদার। কিন্তু এসব ঘরে বাসিন্দারা উঠতে না উঠতেই প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে সদ্যনির্মিত অনেক ঘর ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে অভিযোগ উঠেছে যে, দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন জেলায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে এবং যথাযথ নির্মাণমান বজায় রাখা হয়নি। আর এ কারণেই সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই সদ্যনির্মিত ঘরগুলোর বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়ছে। বাস্তবায়নের মাঝপথেই একটি উদার প্রকল্পে এমন দুর্গতি সরকারের জন্য যেমন বিব্রতকর তেমনি অত্যন্ত দুঃখজনক।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে একইদিনে একসঙ্গে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনা পয়সায় দুই শতাংশ খাসজমির মালিকানামহ দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের শুরু। ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আশ্রয়ণ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর অবধি মোট ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। আর বর্তমান আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে ২০২০ সালে ভূমিহীন ও গৃহহীন মোট ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি পরিবারের তালিকা তৈরি করা হয়। এতে দেখা যায়, সারা দেশে ঘরও নেই, জমিও নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১টি। আর ভিটেমাটি আছে কিন্তু ঘর জরাজীর্ণ কিংবা ঘর নেই এমন পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬১টি। পর্যায়ক্রমে এই তালিকার প্রায় ৯ লাখ গৃহহীনের সবাইকে ঘর বানিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। সরকারি তথ্যানুযায়ী এই প্রকল্পের আওতায় সদ্যসমাপ্ত জুন মাস পর্যন্ত ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে এভাবে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আরও ১ লাখ ঘর প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। অর্থাৎ ৯ লাখ গৃহহীন-ভূমিহীনকে ঘর বানিয়ে দেওয়ার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে।
প্রশ্ন হলো এমন একটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের যে কর্মকর্তারা দায়িত্বে ছিলেন আর বিভিন্ন পর্যায়ের যে জনপ্রতিনিধিরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা কেন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলেন না? নীতিমালা অনুযায়ী এসব ঘর বরাদ্দ থেকে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত ৫ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা। ইউএনওর নেতৃত্বে কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে, অনেক উপজেলায় ইউএনও কোনো সভা না করেই কাগজে-কলমে কমিটি গঠন দেখিয়ে একাই সব কাজ করতেন। মালামাল কেনাসহ কমিটির তদারকিতে ঘর নির্মাণ করার নিয়ম থাকলেও সদস্যদের উপেক্ষা করা হয়েছে। সদ্যনির্মিত ঘর ভেঙে পড়া এবং নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠার পর এখন সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। বুধবার দেশ রূপান্তরে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম ৫ কর্মকর্তা ওএসডি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলায় এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়া নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো থেকে বোঝা যায় যে, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা এবং যথাযথ নির্মাণমান অনুসরণ না করার কারণে এসব ঘর এখন বাসিন্দাদের জন্য আরেকটি সংকট সৃষ্টি করবে। সেটা রক্ষণাবেক্ষণের। এমতাবস্থায় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ এবং অনিয়মে অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই যথেষ্ট নয়। গৃহহীনদের এসব ঘর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণেও সরকারকে আরও দায়িত্ব নিতে হবে। একইসঙ্গে চলমান প্রকল্পে দেশব্যাপী আরও কয়েক লাখ ঘর নির্মাণে কাম্য মানে নির্মাণ শেষ করতে আরও সচেতন থাকতে হবে। তাহলে এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে একদা ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবনমানে কাক্সিক্ষত উন্নতি নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি এই পরিবারগুলোকে নানা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং প্রয়োজনে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হলে তা দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।