টাইলস ব্যবসায়ীর ৩৯ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি, গোয়েন্দার মামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতর একটি টাইলস বিপণনী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে। ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় সোমবার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য জানিয়েছেন।তিনি জানান, ভ্যাট ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম মোহাম্মদ ট্রেডিং। উত্তরার জসিমউদ্দীন এভিনিউয়ের আরএকে টাওয়ারের ৭ম তলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়।
প্রতিষ্ঠানটি আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড এবং স্টার সিরামিক লিমিটেডের নিকট থেকে বিভিন্ন সাইজের টাইলস এবং স্যানিটারি আইটেম ক্রয় করে তা স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করে।
মইনুল খান জানান, প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভ্যাটযোগ্য সেবার বিপরীতে প্রযোজ্য রাজস্ব যথাযথভাবে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান না করে ও সঠিক বিক্রয় তথ্য গোপন করে ঘোষণা বর্হিভূত স্থানে মূসক সংক্রান্ত দলিলাদি সংরক্ষণ করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছে এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছে, এমন একটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট গোয়েন্দার একটি দল গত বছরের ৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বর্হিভূত স্থানে (নর্দান পল্লী ৮৯, গাউসুল আজম এভিনিউ, সেক্টর-১৪, উত্তরা, ঢাকা) আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করে। এতে অভিযোগটির সত্যতা পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট সংক্রান্ত মূল দলিলপত্র মোড়কজাত করে এগুলো ধ্বংস করার জন্য ওই স্থানে স্তুপ করা হয়েছিল। অভিযানে জানা যায়, ভ্যাট গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় থেকে এগুলো গোপনে ধ্বংস করার জন্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।’
গোয়েন্দা দল তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় আরএকে টাওয়ারে (৭ম তলা) একই সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করে। সংস্থাটির উপপরিচালক তানভীর আহমেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেন।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে অভিযানকালে দেখা যায়, এটি নিবন্ধনের ঘোষণা বহির্ভূত স্থান। অভিযানের পর উক্ত কার্যালয়ের কর্মকর্তারা তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেন। পরে ঘটনাস্থলে মালিকপক্ষকে অনুরোধ করলে তারা প্রতিষ্ঠান খুলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেন।
এ সময় অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের চাহিদা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিত কর্মকর্তারা ভ্যাট সংক্রান্ত নথিপত্র প্রদর্শন করেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত কম্পিউটারসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক দলিলাদি তল্লাশি করা হয়। এর সূত্র ধরে পরবর্তীতে মূসক সংক্রান্ত সকল দলিলাদি জব্দ করা হয়।
তদন্তকালে প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট প্রতিবেদন, দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের জমা করা ট্রেজারি চালানের কপি ও অন্যান্য দলিলাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত আড়াআড়ি যাচাই করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।তদন্তের মেয়াদ ছিল জানুয়ারি ২০১৮ থেকে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত ।
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রকৃত বিক্রয় মূল্যের বিপরীতে ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট প্রদান না করে শুধুমাত্র বিক্রয় করা পণ্যের মূল্যের বিপরীতে প্রাপ্ত কমিশনের উপর ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক প্রদান করেছেন। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এসআরও (নং ১২৪-আইন/২০১৫/৭৩০- মূসক, তারিখ: ০৪ জুন ২০১৫ এবং এস এর ও নং ১৭৪ আইন/২০১৮/৭৯৭ মূসক, তারিখ: ০৭ জুন ২০১৮) অনুযায়ী ব্যবসায়ী পর্যায়ে প্রকৃত সরবরাহ মূল্যের বিপরীতে ৪ শতাংশ ও ৫ শতাংশ হারে মূসক প্রদানের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত সরবরাহ মূল্য প্রদর্শন না করে কমিশনকে বিক্রয় মূল্য হিসেবে প্রদর্শন করে তার বিপরীতে মূসক পরিশোধ করেছে।প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূসক পরিশোধের এই আইনি বাধ্যবাধকতাকে লঙ্ঘন করেছে মর্মে তদন্তে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয় মূল্য ২১ কোটি ২৪ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৮ টাকা কমিশন প্রদর্শন করেছে, যার উপর তারা ১ কোটি ৫৪ লাখ ৬৫৫ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কমিশনসহ মোট ভ্যাটযোগ্য বিক্রয় মূল্য ছিল ৬৩২ কোটি ৩৩ লাখ ৭ হাজার ৯৮২ টাকা এবং এর উপর প্রযোজ্য ভ্যাটের পরিমাণ ২৮ কোটি ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭০ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ২৭ কোটি ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ২১৫ টাকা ফাঁকি উদঘাটিত হয়। এই ফাঁকির উপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাস ভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ১১ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ৬৮২ টাকা বিলম্বজনিত সুদ হিসেবে প্রযোজ্য হবে।
অন্যদিকে তদন্তে দেখা যায় যে, উল্লিখিত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫৭০ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ২০ লাখ ৭৭ হাজার ১০২ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৯ লাখ ৪৮ হাজার ৫৩২ টাকা ফাঁকি উৎঘাটিত হয়।এই ফাঁকির উপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ৫ লাখ ১২ হাজার ৩২৫ টাকা সুদ টাকা আদায়যোগ্য হবে।
বর্ণিত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ২৭ কোটি ৪৫ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৭ টাকা এবং সুদ বাবদ ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার ৬ টাকাসহ ৩৮ কোটি ৯৯ লাখ ৩২ হাজার ৭৫৪ টাকা পরিহারের তথ্য উদঘাটিত হয়।
তদন্তে আরও দেখা যায় যে, প্রতিষ্ঠানটি সরকারের ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে মিথ্যা তথ্যসহ নানা ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে যা ভ্যাট আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভ্যাট আইনে এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তদন্তে উদঘাটিত পরিহারকৃত ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদনটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে প্রেরণ করা হয়েছে। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট গোয়েন্দা ১২৪ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির ভিন্ন একটি মামলা দায়ের করেছিল যা বর্তমানে বিচারিক প্রক্রিয়ায় চলমান রয়েছে।