বদলে যাওয়া শৈশব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ লেখাটি যখন লিখছি; তখন বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। সঙ্গে ব্যাঙের ডাক। আরও কিছু অদ্ভুত শব্দ সঙ্গে। সেসব কিসের ডাক জানা নেই। দূরে কোথাও থেকে থেকে শেয়াল ডেকে উঠছে। বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। সাধারণত সন্ধ্যার পর একটানা বিদ্যুৎ গিয়ে এতক্ষণ থাকে না। আজ ব্যতিক্রম।
আকাশে অসংখ্য তারা। বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে ছাদ থেকে দূরাকাশে তারাদের অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। আমি যখন ছোটবেলায় এ গাঁয়ে থাকতাম; তখন আমাদের লম্বা একটি টেবিল ছিল। সে টেবিল উঠোনে নিয়ে এমনি করে অনেক রাতেই তারা দেখতাম। জীবনের প্রয়োজনে গ্রাম ছেড়েছি দীর্ঘ সতেরো বছর হলো। ছুটিতে অল্প সময়ের জন্য এলেও এমন করে গ্রামে ফেরা হয়নি কখনো। ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া করোনা সংকট দীর্ঘকালীন আটকে দিয়েছে গ্রামে।
আমাদের এখনো সৌভাগ্য যে, করোনা এখনো এদিকটায় আসেনি। তাই জীবনযাপন পুরোপুরি স্বাভাবিক। আলসে জীবনে প্রতিদিন সকালে চার ক্রোশ হাঁটা হয়। দীর্ঘদিন পর শৈশবের চেনা পথে যখন হাঁটি, অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব হয়। যেন;
‘এ মেঠোপথ, জলরাশি সব, সকলি আমার চেনা,
পথের ধূলিকণা শুধায় ডাকিয়া, ‘কেন হয়েছিলে অচেনা?’
মনে মনে হেসে বলি, ‘অচেনা আমি হইনি বলেই, ছুটি যে বাড়ীর পানে,
রোজ ভোরে আজও ঘুম ভেঙ্গে যায়, কাঠমালতির টানে’।’
স্কুল হোস্টেল থেকে আনা কাঠমালতিটা দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে ফুল দিয়ে যাচ্ছে। পাশেই শিউলি ফুল গাছ। ছোটবেলা থেকেই বাগান করার শখ। তাই তো গন্ধরাজ, বেলি, প্রেমনলিনী, কামিনী, চেরি, জেসমিন, অলকানন্দা, বাগানবিলাস, চায়না রোজ, চায়না টগর, বকুল, হাস্নাহেনা, রঙ্গন, মাধবীলতা, ডালিয়া, পর্তুলেকা, দোলনচাঁপা, পাম লিলির পরিচর্যায় ও ফুলের সৌন্দর্য অবলোকনে কাটে করোনাকালীন দিনানিপাত।
হিজল ফুল বেশ প্রিয়। আজ যে জায়গাটা দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে, ছোটবেলায় সেখান দিয়ে বর্ষায় স্রোত যেত। জলে অর্ধনিমগ্ন হিজল গাছ যখন জলের ওপর তার ফুল বিছিয়ে দিত, নৌকোয় বসে শুধু তাই দেখতাম। যদিও আশেপাশে হাঁটলে হিজল ফুলের পরিচিত গন্ধ আজও পাই। রাস্তা হওয়ায় জলের ওপর সেই হিজল ফুল আর খুব একটা দেখা যায় না। জলের উপরের হিজল ফুল দেখা না গেলেও বৃষ্টিস্নাত কদমটা আজও টিকে আছে স্বমহিমায়।
এখন যেমন রাস্তা হয়েছে, ছোটবেলায় এমন ছিল না। ধানক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য যে নালা তৈরি করা হতো, তার ওপর দিয়ে হেঁটেই আমরা স্কুলে যেতাম। রাস্তার দু’পাশে ছিল ঝোপ-ঝাড়। ঝোপের ওপর ছিল স্বর্ণলতা। রাতে এই ঝোপঝাড় ও স্বর্ণলতার ফাঁকেই দেখা যেত প্রচুর জোনাকি পোকা। ক্ষুদ্র হলেও টিমটিম করা জ্বলা আলোয় জোনাকিদের মনে হতো দূরাকাশের তারাদেরই একটা ক্ষুদ্র অংশ। যদি কখনো মন খারাপ হতো, মনে হতো যেন তারারাই পাঠিয়েছে এদের;
‘কদম ফুলেরা ডালে ডালে নাচে, হিজলেরা জলে জলে,
শিউলী তাহার গন্ধ ছড়ায়, সন্ধ্যা-সকালে।
জ্যোৎস্না রাতের তারারা আমার, মান ভাঙ্গানোর ছলে,
জোনাকিদের পাঠিয়ে দিয়ে, কত কথাই না বলে!’
আজকাল স্বর্ণলতা ও জোনাকির এমন সম্মিলন খুব একটা দেখা যায় না। জ্যোৎস্নাটা আগের মতোই আছে। ছাদ থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত জ্যোৎস্নার আলোয় চকচক করে ওঠে। কিছুদিন হলো সেই বিস্তৃত ফসলি জমি তলিয়ে শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। বর্ষার জলে জ্যোৎস্না এখন ঝিকিমিকি করে।
ছোটবেলায় বর্ষা আসি আসি সময়টা ছিল সবচেয়ে আনন্দের। গোমতী নদীর শাখা নদী ধনাগোদা পেত তার নব যৌবন। বাল্যবন্ধুরা মিলে প্রতিদিন বিকেলে শুরু হতো নদীতে ঝাপ দেওয়ার প্রতিযোগিতা। কে কতবার উল্টে উল্টে নদীর জলে ঝাপ দিতে পারে, কে কত উঁচু থেকে পিচ্ছিল মাটি বেয়ে জলে ঝাপ দিতে পারে অথবা জলে নেমে ছোঁয়াছুঁয়ি হতো খেলার বিষয়বস্তু।
নদীতে এখন তেমন আর জলযান চলে না। তাই খরস্রোতা নদী এখন কচুরিপানার দখলে। কচুরিপানায় ঢেকে থাকা বর্ষার টইটুম্বুর জল বর্তমান কিশোরদের আর টানে না। যা টানে তা হলো মোবাইল গেমস! একসময়ের কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, কানামাছি ভো ভো খেলা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তবে করোনায় স্কুল ছুটির অফুরন্ত অবসরে ঘুড়ি উড়ানোর নেশা জেগেছে বালকদের। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘুড়ি বানিয়ে এমন সব ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়, যা ছোটবেলায় আমরা কল্পনাও করতাম না। আমাদের সময় ছিল বড়জোর রম্বসাকৃতির একটি, আরেকটি বাক্সঘুড্ডি।
বর্ষায় বিলের জলে যে শাপলা ফুটতো, কালের ব্যবধানে আজকাল তা তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই রক্তিম সূর্য যখন অস্তপারে, পাখির কিচিরমিচির, বকের উড়ে যাওয়া আজও বদলায়নি। শখের বসে সাঁতার কাটি ঘণ্টাখানেক প্রতিদিন। সাঁতারের সময় যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, জলের ওপর আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা, আহা! যেন মুক্তো ঝরে। শৈশবে এমন স্মৃতিতে সে সময়ের বালক মনে স্বপ্ন হতো;
‘বিলের জলে শাপলার ফুল, বাতাসে দোল খায়
ষোড়শী বালিকা মায়াবি নয়নে, ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,
পশ্চিম গগনে সূর্যাস্ত আজ, রক্তিম সন্ধ্যায়
বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে বিলে, লজ্জায় মুখ লুকায়।
তরণীতে আমি, তীরেতে তুমি, যোজন যোজন দূর
মনে আশ জাগে তোমায় লইয়া, পার হইবো সমুদ্দুর,
তোমায় লইয়া বাঁধিব ঘর, ওপারের দূর গাঁয়
যেথায় কোকিল মধুর কণ্ঠে, কবিতার গান শোনায়।’
বৃষ্টির সময়ই ছোটবেলায় বাড়ি থেকে যে পাশ দিয়ে জল নামতো পুকুরে, সে পাশ দিয়ে উঠে আসতো কই, পুঁটি, টাকি ও শোল মাছ। খালে-বিলে তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে এদিকটায়। এর কারণ টেকসই উন্নয়নের ধারণায় জীবনযাপনের অভাব। ডিমওয়ালা প্রচুর মাছ নিধন ও চাষাবাদে কীটনাশকের অত্যাধিক ব্যবহারে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ হেতু বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত ভোগবাদের যে ধারণায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ, সরকারি ও স্থানীয় উদ্যোগে; সেটার যথাযথ প্রয়োগই পারে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে।
উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদল হচ্ছে গ্রামীণ জীবনেরও। এককালের বিটিভি কেন্দ্রীক জীবন পেছনে ফেলে দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভিত্তিক ‘আকাশ ডিটিএইচ’। মা-মাসি-পাড়া-প্রতিবেশী বসে চুলে বেণী করা বা উঠোনে বসে নকশীকাথায় সেই স্বপ্নবুনন চোখে পড়ে না খুব একটা। টেলিভিশন চ্যানেল ও মোবাইল ফোন বিনোদন স্থান করে নিচ্ছে অনেক পুরাতন চর্চাকেই।
করোনা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আমার শৈশব, কিন্তু এ যেন কিছুটা বদলে যাওয়া শৈশব। জীবনের প্রয়োজনে যত দূরদেশেই যাই না কেন, বদলে যাওয়া শৈশব স্মৃতি বিজড়িত স্থানের ধুলো-বালিতেই মিশে যেতে চাই একদিন;