নদীভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে

0

বর্ষা শুরু হতে না হতেই এবার দেশের বিভিন্ন জেলায় নদীভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তার ভাঙনে রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মাদারিপুর, ভোলা, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি জেলায় নদী ভাঙনে শত শত বিঘা আবাদী জমি, বাড়ি-ঘর, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা একের পর এক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফসলি জমি ও বাড়িঘর হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব, আশ্রয়হীন ও উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। ভাঙনের ফলে এলাকার মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রতি বছরই ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ নিয়ে পরিসংখ্যানও প্রকাশিত হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। গত বছর সিইজিআইএস আশঙ্কা করেছিল, ১৩টি জেলায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে। বাস্তবে দেখা গেছে, ভেঙেছে ৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা। নদীভাঙনের এ ভয়াবহতার বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। দিলে ভাঙন বাড়বে কেন? ভাঙন রোধে একের পর এক প্রকল্প নেয়া হলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ভাঙন তীব্র হয়ে উঠছে। নদীভাঙন অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড়ে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি ভাসিয়ে নিলেও ভূখন্ড অক্ষুন্ন থাকে। মানুষ নতুন করে ঘর বাঁধতে ও ফসল ফলাতে পারে। নদীভাঙন এমনই যে, এতে মানুষ ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সমৃদ্ধ পরিবার সর্বহারা হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় থামানো না গেলেও তার আঘাতে ক্ষয়-ক্ষতি এবং মানুষের প্রাণহানি কমানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেয়ায় কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া গেছে। কার্যকর উদ্যোগ নিলে এবং তা বাস্তবায়ন করলে নদীভাঙন থেকে জমিজমা, বাড়িঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব। অথচ নদীভাঙনে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সব হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। গত বছরও আমরা দেখেছি, অসংখ্য বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ইতোমধ্যে প্রায় তিনশ’ ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করেছে। প্রতি বছরই এসব এলাকায় কমবেশি ভাঙন দেখা দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হলেও তা রোধে আগাম ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন? কেবল ভাঙন দেখা দিলেই কোনো রকমে জিও ব্যাগ ও বস্তা ফেলে জোড়াতালি দেয়া হয়। স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙন রোধে যেসব উদ্যোগ নেয় তা কোনো কাজে আসে না। যেসব বাঁধ নির্মাণ ও বস্তা ফেলা হয় সেগুলো পানিতেই ভেসে যায়। এভাবে বর্ষা পার হলে আর কোনো খবর থাকে না। আবার বর্ষা এলে পূর্বের মতোই লোক দেখানো কিছু সংস্কার করা হয়। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও স্থায়ী কোনো সমাধান মিলছে না। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনাসহ সংস্কারের যেসব প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয় তার ৭০ শতাংশই সংশ্লিষ্টদের পকেটে চলে যায়। এ এক ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র। এর অর্থ হচ্ছে, এসব প্রকল্প একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যৌথ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নামকাওয়াস্তে কিছু বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করে সিংহভাগ অর্থ নিজেরা লুটপাট করে নিচ্ছে। অথচ নদীভঙনে যেসব মানুষ জমিজিরাত ও বসতবাটি এবং জীবিকা হারাচ্ছে তারা শুধু নিঃস্ব ও উদ্বাস্তুই হচ্ছে না, দেশের অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত চার দশকে প্রায় এক লাখ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। নদীভাঙনের ক্ষয়-ক্ষতি পূরণের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। যেসব মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সব হারিয়েছে, তারা আর তা ফিরে পায় না। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের কাজ যথাযথভাবে করলে নদীভাঙন রোধ করা অসম্ভব কিছু নয়। এটা কেমন কথা, বছরের পর বছর নদীভাঙন তীব্র হবে, অথচ তার প্রতিকারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ থাকবে না? নদীর ভাঙনপ্রবণ এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা কি করছেন? ভাঙনপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হলেও সেখানে কেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিৎ। নদীভাঙন রোধ এবং নদীশাসনে যে প্রকল্প নেয়া ও বরাদ্দ দেয়া হয়, তার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাঁধ নির্মিত হয়েছে কিনা, নির্মিত হলেও টেকসই কিনা, সেটা নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের দুর্নীতির কারণে বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন ও অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হবে, তা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না।