দেশে করোনা টেস্ট বাড়াচ্ছে না কর্তৃপক্ষ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।এ অবস্থায় জেলাগুলোতে আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে টেস্টের মেশিন, ল্যাবরেটরি এবং এই পরীক্ষার দক্ষ লোকবলের সঙ্কট প্রকট হয়েছে। সেজন্য ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের হারের সাথে পাল্লা দিয়ে আরটিপিসিআর টেস্ট বাড়ানো যাচ্ছে না বলে বিভিন্ন জেলা থেকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আরটিপিসিআর টেস্টের সঙ্কটের কারণে সংক্রমণের সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলেছে, সংক্রমণের হটস্পটগুলোতে ব্যাপকভিত্তিতে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা হলেও মানুষের আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখনো আরটিপিসিআর টেস্টের সুবিধা সীমাবদ্ধ রয়েছে কিছু শহরে, যে শহরগুলোতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। সেই শহরের ওপর আরটিপিসিআর টেস্টের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে আশপাশের জেলাগুলোকে। দেশের উত্তরপশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এর পাশের জেলা নাটোর, নওগাঁ এবং রাজশাহীতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই জেলাগুলোর মানুষের আরটিপিসিআর টেস্টের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দু’টি মেশিন এবং রাজশাহী সদর হাসপাতালের একটি মেশিনের ওপর।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের যে ভাইরোলজি বিভাগ এই টেস্ট করছে, সেই বিভাগের অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার বলেছেন, এখন কয়েকটি জেলা থেকে টেস্টের নমুনা বেশি আসছে, কিন্তু চাপ সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। অধ্যাপক গুলনাহার বলেন, এখন আমাদের কাছে প্রায় সাত শ’ থেকে আট শ’ নমুনা আসে প্রতিদিন। আমরা আগে তো একটা শিফটে পরীক্ষার কাজ করতাম। সেটা বাড়াতে বাড়াতে এখন পাঁচ শিফটে কাজ করছি। এই পাঁচ শিফটে প্রায় ৪৭০টা টেস্ট করতে পারি। কিন্তু দক্ষ লোকবলেরও সঙ্কটও যে রয়েছে, তাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক সাবেরা গুলনাহার। আমাদের দুইটা মেশিনে একই জনবল দিয়ে কাজ করতে হয়। দুই সেট লোকতো নেই। একটা শিফটে লাগে তিনজন টেকনোলজিস্ট, একজন মলিকুলার বায়োলজিস্ট এবং তিনজন ডাক্তার। এই একই লোক দিয়ে করতে হচ্ছে। তারাতো লম্বা সময় কাজ করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহে যে জেলাগুলোতে সংক্রমণ হু হু করে বেড়েছে, তার মধ্যে দক্ষিণ পশ্চিমের সীমাবর্তী জেলা সাতক্ষীরাতেও সংক্রমণের হার গড়ে ৪৫ শতাংশের ওপরে থাকছে। সেই জেলার জন্য সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একমাত্র আরটিপিসিআর মেশিন।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা: মো: হুসাইন শাফায়াত বলেছেন, সীমাবদ্ধতার কারণে শুধু সন্দেহজনকদেরই টেস্ট করা হচ্ছে। ডা: হুসাইন শাফায়াত বলেন, আমাদের পিসিআর মেশিন একটা। তাতে একবারে সর্বোচ্চ ৯২টা টেস্ট করা যায়। সে ক্ষেত্রে আমরা দুই শিফটে ১৮২ বা ১৮৭টা পর্যন্ত টেস্ট করতে পারছি। আর র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট হচ্ছে, তাতে পজিটিভ হলে চিকিৎসার জন্য পাঠাই। আর নেগেটিভ হলে তার কোনোটা যদি সন্দেহ হয়, সেগুলোও আরটিপিসিআর টেস্টের জন্য পাঠাতে হয়। তিনি আরো বলেছেন, ‘সাতক্ষীরায় আমরা যদি মনে করি ২২ লাখ লোক আছে, তাদের সামগ্রিক চিত্র পেতে গেলে যে হারে টেস্ট করা দরকার, এই মুহূর্তে সে পরিমাণ টেস্ট করার সক্ষমতা বা অবকাঠামো তৈরি করতে পারবো না। সেজন্য আমরা সন্দেহজনকদের মধ্যেই টেস্ট সীমাবদ্ধ রেখেছি।’ সংক্রমণ বাড়ছে- এমন বেশিরভাগ জেলা থেকেই আরটিপিসিআর টেস্টের সঙ্কটের একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে এই সঙ্কট প্রকট হয়েছে।
তবে রাজশাহী, নওগাঁ এবং সাতক্ষীরাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় রাস্তায় বা লোকসমাগম হয়, এ ধরনের পয়েন্টে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ব্যাপকভিত্তিতে। তাতে মানুষ আগ্রহ কম বলে স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন। তারা মনে করেন, নিজের এলাকায় সংক্রমণ বাড়তে থাকলেও সাধারণ মানুষ টেস্টের ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে না। অন্য দিকে বিশ্লেষকরা মনে করেন এই অ্যান্টিজেন টেস্টে ফলস নেগেটিভ হওয়ার সংখ্যা বেশি থাকে। ফলে এই টেস্টের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কম হওয়ার সেটিও একটি কারণ হতে পারে। এমন একজন ভুক্তভোগী রাজশাহীর বুলবুল হাবিব। তিনি বলেছেন, ‘গত রোববার রাজশাহী শহরে আমি অ্যান্টিজেন টেস্ট করলে আমার নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। কিন্তু পর দিন আমার শরীরে ব্যথা হয়। এর পরদিন রাজশাহী মেডিক্যালে পিসিআর টেস্টে পজিটিভ রেজাল্ট পাই। এরপর থেকে বাসায় চিকিৎসায় আছি।’
অন্যতম একজন বিশেষজ্ঞ ড. বেনজীর আহমেদ টেস্টের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কৌশলে গলদ দেখছেন। যারা টেস্ট করতে আসছে, আমরা শুধু তাদেরকেই টেস্ট করছি। এতে আসল চিত্র জানা যাবে না। প্রকৃত চিত্র জানতে হলে কন্টাক্ট ট্রেসিং করে ব্যাপক হারে টেস্ট করতে হবে। তবে টেস্টের ক্ষেত্রে কোনো সঙ্কট নেই বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ড. নাজমুল ইসলাম। একটি জেলায় আরটিপিসিআর মেশিন থাকা মানেই সেখানে টেস্ট কম বা বেশি হবে-তা কিন্তু নয়। কারণ বিভিন্ন জায়গা থেকে (নমুনা) সংগ্রহ করে একটি জায়গায় এনে পরীক্ষা করে ফলাফল কিন্তু দিন দিনে দেয়া যায়। সেখানে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নমুনা দেয়ার জন্য লোকজন সেভাবে না এলে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো যায় না। তিনি আরো বলেছেন, আমাদের অঞ্চলভিত্তিতে আরটিপিসিআর ল্যাব আছে। সেগুলোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। একইসাথে ড. নাজমুল ইসলাম আরটিপিসিআর টেস্টের জন্য দক্ষ লোকবলের সঙ্কটের বিষয় স্বীকার করেছেন। ড. নাজমুল ইসলাম বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আরটিপিসিআর মেশিন চালানোর জন্য যে পর্যাপ্ত দক্ষ লোকবল এবং যে ধরনের ল্যাবের দরকার হয়, সেটাও কিন্তু আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আমাদের এই দক্ষ জনশক্তির খানিকটা ঘাটতি আছে এবং যেটি এ মুহূর্তে আরো প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। অন্য দিকে এসব বিভিন্ন জেলা থেকে হাসপাতালে আসন সঙ্কট বা চিকিৎসার ঘাটতির বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি