সমস্যা সেরামে, টিকার অভাবে ভুগছে বিশ্ব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বাংলাদেশ, নেপাল থেকে শুরু করে রুয়ান্ডাসহ বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পটগুলো টিকা স্বল্পতায় ভুগছে। অনেক দেশেই স্থগিত করতে হয়েছে টিকাদান কর্মসূচি। এসব দেশে টিকা স্বল্পতার জন্য দায়ী মাত্র একটি কোম্পানি: দ্য সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী সেরামকে গত বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগের একটি শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে ভারতীয় কোম্পানিটি ধুঁকতে শুরু করে। রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু কারখানায় আগুন, সব মিলিয়ে যেসব অর্ডার তারা পেয়েছিল সেগুলো পূরণ করতে পারেনি। প্রায় ৯২টি দেশকে টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কোভ্যাক্স। কিন্তু এখন পর্যন্ত ন্যূনতম ২০ কোটি ডোজের মধ্যে সেরামের কাছ থেকে তারা পেয়েছে মাত্র ৩ কোটি। যা টিকা সরবরাহের শুরুতে দিয়েছিল সেরাম। ভারতীয় কোম্পানিটির এই বিপর্যস্ত অবস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা প্রয়োগে ব্যর্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্র। এতে সতর্ক বার্তাও উঠে আসছে, বৈশ্বিক সংকটের সময় কোনও একটি উৎপাদনকারীর ওপর ভরসা করা যাবে না। সরবরাহে ঘাটতি এমন সময় দেখা দিয়েছে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, দরিদ্র দেশগুলোতে কম মাত্রায় টিকা দেওয়ার কারণে ভাইরাসটির বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব এবং বৈশ্বিক মহামারি বিলম্বিত হতে পারে। বিশ্বের আরও কয়েকটি কোম্পানিও তাদের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ডোজ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়েছে বা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু সেরামের ব্যর্থতার পরিণতি অনেক ভয়াবহ। কারণ, কোভ্যাক্স ও উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রধানভাবে কোম্পানিটির ওপর নির্ভরশীল ছিল। এপ্রিল থেকে কোম্পানিটি দেশের বাইরে কোনও ডোজ পাঠাতে পারেনি। ওই সময় ভারতে ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন সংকটে পড়তে শুরু করে সেরাম।
গত বছর সেরামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদর পুনাওয়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ৪০ কোটি ডোজ উৎপাদন করা হবে ২০২০ সালের মধ্যে। কিন্তু ২০২১ সালের শুরুর দিকে তিনি জানান, ভারতে অনুমোদন পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ও পর্যাপ্ত গুদামের ব্যবস্থা না থাকায় তারা মাত্র ৭ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করেছেন। একাধিক দেশ সেরামের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করে টিকা কেনার জন্য। কিন্তু এসব দেশকে এখন নতুন সরবরাহকারী খুঁজতে হবে। করোনার দ্বিতীয় দফার সংক্রমণে বিপর্যস্ত নেপাল সরকার জানিয়েছে, সেরামের কাছ থেকে সরাসরি তারা অর্ডারের অর্ধেক ১০ লাখ ডোজ পেয়েছে। দ্বিতীয় চালানে বাকি টিকা মার্চ মাসে পাওয়ার কথা ছিল। নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবার কল্যাণ বিভাগের প্রধান তারানাথ পোখরেল বলেন, ভ্যাকসিন স্বল্পতায় আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। সব মিলিয়ে নেপালে ২ কোটি ৮ লাখ মানুষের মধ্যে ২৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। এরমধ্যে সেরামের কাছ থেকে সরাসরি কেনা ১০ লাখ, আরও ১০ লাখ এসেছে ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে এবং অবশিষ্ট ডোজ দিয়েছে কোভ্যাক্স। নেপাল সরকার কোভ্যাক্স থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ ডোজ পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। কিন্তু কোভ্যাক্স সেরামের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এসব ডোজ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ, সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতীয় কোম্পানিটি কোনও টিকা রফতানি করছে না। কোভ্যাক্স উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষক ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি’র প্রধান নির্বাহী প্রধান সেথ বার্কলি বলেন, সেরামকে কোভ্যাক্সের বৃহত্তম সরবরাহকারী হিসেবে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল মূলত কোম্পানিটির বিশাল উৎপাদন ক্ষমতা, স্বল্পমূল্যে সরবরাহের সক্ষমতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি অনুমোদন পাওয়া টিকাগুলোর মধ্যে একটি ছিল সেরামের ভ্যাকসিন। গ্যাভি কর্মকর্তা বলছেন, সেরামের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে, যা ভারতের কাজে লাগবে। এরপরও, ২০২১ সাল পর্যন্ত রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা প্রকাশের পর কোভ্যাক্স ও উন্নয়নশীল দেশগুলো টিকার নতুন উৎস খুঁজে পেতে সংকটে পড়ছে। টিকার এই স্বল্পতা পূরণ করতে পারে চীনা কোম্পানি। চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক ও সিনোফার্ম গ্রুপ কোম্পানির টিকা সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে। সেরামের সরবরাহ ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কিছু দিন প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ করেছিল। পরে পুরো টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। সম্প্রতি চীনা সিনোফার্মের ভ্যাকসিন পাওয়ার পর স্বল্পমাত্রায় টিকাদান শুরু হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে ফ্রন্টলাইন ও জরুরি সেবাকর্মীদের। কিন্তু গণটিকাদান কর্মসূচি পুনরায় শুরু করা হয়নি।
জানুয়ারির শুরুতে আদর পুনাওয়ালা বলেছিলেন, ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনে প্রত্যাশার চেয়ে গতি মন্থর হওয়ার কারণে ভায়াল মজুতের গুদামের অভাবে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে কোম্পানিটি জরুরি অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। সম্প্রতি পুনাওয়ালা সেরামের কিছু সমস্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কথাও তুলে ধরছেন। বিশেষ করে টিকার গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল রফতানিতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কথা বলছেন তিনি। জানুয়ারিতে সেরামের একটি কারখানায় আগুন লাগে। শুরুতে এর প্রভাব অস্বীকার করেছিল কোম্পানিটি। পুনাওয়ালা টুইটে বলেছিলেন, এতে উৎপাদন মন্থর হবে না। কিন্তু বাস্তবে এর ফলে সরঞ্জামের ক্ষতি ও অতিরিক্ত উৎপাদন এবং কারখানার বিস্তৃতি বাধাগ্রস্ত হয় বলে সেরামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ফিউচার ভ্যাকসিন ম্যানুফেকচারিং রিসার্চ হাব ও ভ্যাকসিন রিসার্চ নেটওয়ার্কের সদস্য ক্লিও কন্টোরাব্দি বলেন, আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তারা ভীষণ বিপাকে রয়েছে। আর কোভ্যাক্সের জন্য এটি বড় ধরনের বিপর্যয়। শুধু সেরাম নয়, অ্যাস্ট্রাজেনেকাও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ভারতীয় আরেকটি কোম্পানি ভারত বায়োটেকও ১০০ কোটি প্রতিশ্রুতির বিপরীতে মাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহ করেছে। রাশিয়া গত মাসে ভারতে স্পুটনিক ভি সরবরাহ শুরু করেছে। তারা এর আগে বলেছিল, গত বছর ডিসেম্বরেই ১০ কোটি ডোজ সরবরাহ শুরু করতে পারবে। নয়া দিল্লিভিত্তিক জনস্বাস্থ্য পর্যালোচনকারী সংস্থা অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সহ-আহ্বায়ক মালিনি আইসোলা বলেন, সব টিকা উৎপাদনকারীই সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং এই প্রবণতা জারি রয়েছে। কোম্পানিগুলো যত উৎপাদন করতে পারে তার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। সূত্র: ব্লুমবার্গ