ভালো খবরের আশায়

0
সৈয়দ আবদাল আহমদ
মৃত্যু আর হতাশার খবর শুনতে শুনতে আমরা সবই এখন ক্লান্ত। করোনা মহামারীর দেড় বছরে গণমাধ্যমে এই খবরই আসছে ঘুরেফিরে। খবরগুলো আর ভালো লাগে না। করোনায় বহু স্বজন, প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, সরকারি কর্মকর্তা, শিল্পীসহ নানা পেশার সৃজনশীল মানুষও রয়েছেন। মাত্র কয়েক দিন আগে আমরা হারিয়েছি দেশের একজন অত্যন্ত গুণী মানুষ, সাবেক সচিব শাহ্ আব্দুল হান্নানকে। তিনি ছিলেন একজন সৎ, কর্মঠ, সমাজসেবক এবং ইসলামের সেবায় নিবেদত একজন বিনয়ী মানুষ। তিনি তার পুরোটা জীবন ব্যয় করেছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। করোনায় তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনামুক্তও হয়েছিলেন। কিন্তু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর বেঁচে থাকতে পারলেন না। মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এটা ঠিক, তিনি পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তবুও তার মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। সহকর্মী মাসুমুর রহমান খলিলী লিখেছেন, ‘ছায়া সরে গেছে’। সঠিক লিখেছেন, তিনি বটবৃক্ষের মতোই ছায়া দিয়ে গেছেন। মানুষের কেমন কল্যাণকামী তিনি ছিলেন তার উদাহরণ হচ্ছে ৮০ বছর পার হওয়ার পর ‘আমার জীবনের উপলব্ধি’ নামে ২০টি পরামর্শের একটি ছোট্ট লেখা লিখে যান। এটা তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। তিনি লিখেন, সবসময় আমি সংযত চিন্তা করেছি। যোগ্যতা অর্জনের জন্য তিনি বেশি বেশি বই পড়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজ গ্রাম বা এলাকায় সমাজসেবার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার কাজ করা, সাধ্যমতো দান করা, মন্দ কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখা, নিয়মিত কুরআন পাঠ ও কুরআনের অর্থ জানা। অফিসের কাজ ফেলে না রাখা, সর্বক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা, রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা, গৃহকর্মী ও শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সদয় থাকা, নারীদের সম্মান করা ও মর্যাদা দেয়া ইত্যাদি তার অন্যতম কয়েকটি পরামর্শ। হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করে তিনি এ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, মধ্যম পন্থাই উত্তম। মহান আল্লাহ কুরআনে মধ্যম পন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত বলেছেন। বিশাল হতাশার মাঝে হান্নান ভাইয়ের এ উপদেশ আশার আলোই ছড়িয়ে দিয়েছে। কর্মজীবনে তিনি সরকারি প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ও ট্রাস্ট, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের চেয়ারম্যান কিংবা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। একজন কাজ-পাগল মানুষ হিসেবে হাসপাতালে ভর্তির আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে নিয়মিত লিখেছেনও, বিশেষ করে ইসলামের নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখা। মহান আল্লাহ সততায় উজ্জ্বল, এই ভালো ও অমায়িক মানুষটিকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন, এ কামনাই করি।
মন ভালো রাখার খবর
লেখার বিষয় খুঁজছিলাম। ইতিবাচক কোনো বিষয় নিয়ে লিখব, এটাই চিন্তায় আসে। খবর খুঁজতে গিয়ে-ইয়েমেনের জেলেদের জীবন বদলে দেয়ার একটি কাহিনী পড়ে খুব ভালো লাগে। বিবিসি খবরটি দেয় ৪ জুন, ২০২১ তারিখে। ইয়েমেনের জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে সাগরে একটি মরা তিমি ভাসতে দেখে। সেটিকে তারা তীরে এনে এর পেট কেটে পায় মহামূল্যবান এক পদার্থ। অনেকটা গুপ্তধন পাওয়া। এডেন উপসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া মৃত স্পার্ম তিমির পেটের ভেতর এ পদার্থ ছিল ‘অ্যাম্বারগ্রিজ’ যার বাজারমূল্য ১৫ লাখ ডলারের বেশি। এই বিরল ও মূল্যবান পদার্থ অ্যাম্বারগ্রিজ সুগন্ধি শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এটা পেয়ে জেলেরা মহাখুশি। যুদ্ধরত ইয়েমেনে দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগ চলছে। ৮০ শতাংশ মানুষই খাদ্যের অভাবে ভুগছে বলে জাতিসঙ্ঘে বলছে। এমন এক পরিস্থিতিতে দরিদ্র জেলেদের ‘অ্যাম্বারগ্রিজ’ পাওয়া অনেকটা আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতোই ঘটনা। একজন জেলে সাক্ষাৎকারে জানান, তারা খুব গরিব। এভাবে যে একটা মহামূল্যবান সম্পদ পেয়ে যাবেন, কখনো কল্পনাও করেননি। অ্যাম্বারগ্রিজ বিক্রি করে তারা অনেক টাকা পেয়েছেন। এটা তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। অ্যাম্বারগ্রিজ আঠালো, মোমের মতো। এটা স্পার্ম তিমির অন্ত্রে পাওয়া যায়। সুগন্ধি ছাড়াও নানা ওষুধে এটা ব্যবহৃত হয়। পারফিউমের সুগন্ধি ধরে রাখতে এটা ব্যবহার করা হয়। জেলেরা আরো জানিয়েছেন তারা ‘অ্যাম্বারগ্রিজ’ বিক্রির টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে ছাড়াও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সমুদ্রের এক শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ স্মার্ম তিমিতে ‘অ্যাম্বারগ্রিজ’ থাকে। এ তিমি এখন নাজুক অবস্থায় আছে। মন ভালো করে দেয়ার মতোই একটি খবর! তুরস্কের জন্য সুখবর হলেও আশা জাগানিয়া খবর। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান জানান, তার দেশ কৃষ্ণসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে ৪০ হাজার ৫০০ ঘন মিটার প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। তাদের তেল গ্যাস অনুসন্ধানকারী জাহাজ ফাতিহর মাধ্যমে সাকারিয়া গ্যাসক্ষেত্রে এ মজুদ পাওয়া যায়। যেটি তুর্কি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গ্যাসের মজুদের সন্ধান। ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্কের আনন্দের এই খবরে আমরাও খুশি। মন ভালো করে দেয়ার আরেকটি খবর ডেনমার্কের। দেশটির সরকার রাজধানী কোপেনহেগেনের উপকূলে একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এতে ৩৫ হাজার লোক বসবাস করতে পারবে। কোপেনহেগেন বন্দরকে সুরক্ষা দিতে এ প্রকল্প। দ্বীপটির নাম দেয়া হয়েছে ‘লিটেনহোম’। একটি রিং রোড, সুরঙ্গপথ ও মেট্রোলাইন দিয়ে দ্বীপটিকে মূলভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। এই তিনটি সুখবর জানার পর আমাদের দেশের ভালো একটি খবর খুঁজছিলাম। জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট পেশ হয়েছে। বাজেটে নিশ্চয় ভালো কোনো খবর পাওয়া যাবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার টাকা। আর মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২.৬ বছর। আশা জাগানিয়া খবর হওয়ারই কথা। কিন্তু মানুষ খবরটিতে নির্ভর করতে পারছে না। প্রায় দুই লাখ টাকা আয় দেশের মানুষের কতজনের আছে? অনেকেরই ধারণা, এটি দেশের সঠিক চিত্র নয়। মানুষের চাকরি নেই, কর্মসংস্থান ও খাবারের জন্য হাহাকার। এ পরিস্থিতির সঙ্গে এটা মেলে না। তেমনি গড় আয়ু নিয়েও গরমিল রয়েছে। করোনা মহামারীর ধাক্কায় নতুন করে যারা গরিব হয়েছেন, কাজ হারিয়েছেন, তাদের সহায়তার কথা বাজেটে নেই। করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে। সে সম্পর্কে কোনো কথা নেই বাজেটে।
কৃষিতে এবার কম ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। অথচ এই কৃষিই দেশ ও মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। করোনায় শিক্ষা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষা খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো পদক্ষেপ বাজেটে নেয়া হয়নি। বরং এমন প্রস্তাব করা হয়েছে যার ফলে শিক্ষা খাত আরো সঙ্কুচিত হয়। প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। অথচ এখন বেশি প্রয়োজন করোনার টিকাদান, অর্থমন্ত্রী ১০ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার কথা বলেছেন। আবার প্রতি মাসে মাত্র ২৫ লাখ লোককে টিকা দেয়া যাবে বলে উল্লেখ করেছেন। এতে টিকা দিতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। টিকাদান যত পিছিয়ে পড়বে, কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসতে ততই দেরি হবে। অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, এই বাজেটে তেলা মাথায় তেল দেয়া হয়েছে। তবে বাজেটের বাইরে চা নিয়ে বাংলাদেশের একটি খবর আশাপ্রদ। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ব্যাপক চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশের সমতলেও চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাহাড়ি উঁচু জমির পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সমতলে জমিতে চা চাষ হচ্ছে, যা মোট চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করবে। বর্তমানে দেশে ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান ও টি এস্টেট রয়েছে। এর মধ্যে ১২৯টিই বৃহত্তর সিলেটে। একটি চা বাগান করতে ২৫ একর জমি লাগে। সমতলের চা বাগানে উৎকৃষ্ট মানে চা হচ্ছে এটি ভালো দিক। ২০২৫ সাল নাগাদ চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্র ১৪ কোটি কেজি নির্ধারণ করে বাগান প্রস্তুত করা হচ্ছে। চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনা হচ্ছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে। এটিও একটা ভালো খবর। করোনা দূর হোক ভালো খবরে ভরে উঠুক দেশ, এমন আশাই সবার।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব