৬০৩৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা আজ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥কভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কায় দেশের আমদানি-রফতানি কমে যাওয়াসহ স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহে স্থবিরতা নেমে আসে। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণে ধস নামে। যার প্রভাব আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে মহামারী মোকাবেলায় সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া মহামারীর প্রভাব পড়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিসহ (এডিপি) অন্যান্য খাতে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোও মনে করছে, এসব খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যয় করতে পারেনি তারা। আগামী অর্থবছরেই এ ঘাটতি পূরণ করে নিতে চায় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এমন বাস্তবতা মেনে নিয়ে আয় নয়, বরং ব্যয়ের দিকে নজর বাড়িয়ে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার আগামী বাজেট চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এবারের বাজেটে আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে প্রথমবারের মতো ঘাটতি দাঁড়িয়েছে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৬ দশমিক ২ শতাংশ। টাকার অংকে যা ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অনুদান পাওয়া গেলে ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরে জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে যা ছিল ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে পরে সংশোধিত বাজেটে এটিকে কমিয়ে ধরা হয় ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আগামীকাল জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেটের প্রায় ৬০ ভাগ ব্যয় হবে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে। এর পরিমাণ ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ১৩ হাজার ৩২০ কোটি টাকা ও সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৩৭ হাজার ৮১২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে পরিচালন খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। তবে ব্যয় সংকোচন নীতির অংশ হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীদের গাড়ি কেনা নিষিদ্ধ করা, বিদেশ ভ্রমণে বরাদ্দ অর্ধেক কমানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে এ খাতে ব্যয় কিছুটা কমেছে। সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হবে ঋণের সুদ পরিশোধে। এ খাতে বরাদ্দের ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ খরচ হবে ৬২ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় হবে ৬ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। ব্যয় সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে আগামী অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ ও পূর্ত কাজ, শেয়ার ও ইকুইটি খাতে বিনিয়োগ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমাবে সরকার। মূলধন ব্যয় নামে এসব খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩২ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৩৬ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব খাতে ব্যয় কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ ২১ হাজার ১৪১ কোটিতে নামানো হয়।
আগামী অর্থবছর উন্নয়ন খাতে সিটি করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ উন্নয়ন খাতে মোট ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। অব্যবস্থাপনা ও সক্ষমতার অভাবে তা বাস্তবায়ন করতে না পারায় সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে ২ লাখ ৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও প্রকৃত বাস্তবায়নের পরিমাণ এর চেয়েও কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগামী অর্থবছর উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ২০ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা বেশি। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এডিপি বাস্তবায়ন না হওয়ায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। করোনা মহামারীতে এডিপি বাস্তবায়ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও চলতি অর্থবছর তা বাস্তবায়নের হার খুবই হতাশাজনক। গত এপ্রিল শেষে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৯৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বরাদ্দের ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। বাস্তবায়নের এ হার গত পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন।
আগামী অর্থবছর সরকার ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের পরিকল্পনা করলেও রাজস্ব আহরণের প্রধান উৎস এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১ টাকাও বাড়ছে না। তবে এনবিআর বহির্ভূত কর ব্যবস্থা ও করবহির্ভূত রাজস্ব যেমন— বিভিন্ন সেবা ফি, জরিমানা, টোল, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও করপোরেশনগুলোর মুনাফা থেকে বাড়তি অর্থ কোষাগারে নেয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে অর্থ বিভাগ। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত অর্থবছর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আগের অর্থবছরের তুলনায় যখন এনবিআরের রাজস্ব আয় কমে গিয়েছিল, তখন চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় সংস্থাটিকে। যদিও তা অর্জন করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ লক্ষ্যমাত্রা যে পূরণ হওয়ার নয়, তা তখনই অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। কভিডের প্রথম ঢেউ শেষে আমদানি-রফতানিতে কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নেমে আসা ও অর্থনীতি গতিশীল হওয়ার কারণে প্রাথমিক হিসাবে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে সংস্থাটি। তবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছে যেতে পারছে না তারা। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এ লক্ষ্যমাত্রা বহাল রাখা হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছর এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
কর ব্যতীত রাজস্ব খাত থেকে আগামী অর্থবছর ৪৩ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মূলত করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর মুনাফার যে অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকে সঞ্চয় রাখা আছে, সেগুলো কোষাগারে এনে এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন সেবা ফিও বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাত থেকে ৩৩ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরার পর সংশোধিত বাজেটে তা ২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদান পায়, যা ফেরত দিতে হয় না। ফলে বিদেশী অনুদানকে আয় হিসেবে বিবেচনা করে সরকার। আগামী অর্থবছর বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা পাওয়ার আশা করছে অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এটি ছিল ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে ৩ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায় নামানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এত বড় বাজেট বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা নেই। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা সেটা এপ্রিলে এসে কিছু বাড়লেও সার্বিকভাবে অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থাকবে। সরকারের যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের ব্যয় করার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এজন্যই এডিপি ঠিকমতো বাস্তবায়ন হয় না। সব মিলিয়ে এত বড় বাজেট ব্যয় করার সক্ষমতা আমাদের নেই।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নীতি মেনে বাংলাদেশ প্রতি বছর জিডিপির ৫ শতাংশ ঘাটতি রেখে বাজেট প্রণয়ন করলেও কভিড পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা না বাড়িয়ে, ঘাটতি অর্থায়ন বাড়িয়ে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এতে সামগ্রিক ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। কভিড পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছিল, যা ছিল জিডিপির ৬ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমলেও অর্থনীতির আকার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না বাড়ায় জিডিপির অনুপাতে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বৈদেশিক অনুদান পেলে আগামী অর্থবছর বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে আগামী অর্থবছর বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। বিদেশী উৎস থেকে সরকার মোট ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ঋণ নেবে, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৈদেশিক সহায়তা না পাওয়া ও বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬৮ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি ও সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি ও সংশোধিত বাজেটে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর ব্যাংক থেকে সরকার কম পরিমাণ ঋণ করবে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বিঘ্নিত হবে না। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৩০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক ঋণসহায়তা বাড়াতে পারলে ভালো। বাজেট সাপোর্টও আরো পেতে পারে সরকার। কিন্তু এজন্য আর্থিক খাতে কিছু সংস্কারের শর্ত দেয় দাতারা। কিন্তু সরকার সেটা করতে চায় না। সরকার চায় আমরা কোনো সংস্কার করব না, এমনিতেই টাকা দাও। এজন্যই সরকার গত কয়েক বছর থেকে বাজেট সহায়তা পাচ্ছে না। সরকার সব সময় দেশের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কম নিয়ে বৈদেশিক সহায়তা বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয় না। কারণ প্রতি বছর বৈদেশিক সহায়তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম অর্জন হয়। বৈদেশিক সহায়তা কমে গেলে ব্যাংক খাত থেকে বেশি পরিমাণ ঋণ নিতে বাধ্য হবে সরকার।