টেকসই বাঁধ ও টেকসই সুশাসন

0
মীযানুল করীম
ঝড় বাংলাদেশের সাংবাৎসরিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অনেক সময় পূর্বাভাসযুক্ত সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আর পূর্বাভাসহীন আকস্মিক ঝড় একই সময় আসতে পারে। এবার ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ উপকূলে না উঠতেই বাংলাদেশের কোথাও কোথাও টর্নেডো হানা দিয়েছে এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নেয়া হয় পূর্বাভাসমাফিক। তবে টর্নেডোর পূর্বাভাসও মেলে না, তাই প্রস্তুতিও থাকে না মোকাবেলার। এবার ২৫-২৬ মে’র ঘূর্ণিতে জলোচ্ছ্বাস ছিল স্বাভাবিকভাবেই; এটি পূর্ণিমা আর চন্দ্রগ্রহণ মিলে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অস্বাভাবিক উঁচু জোয়ারের জন্ম দিয়েছিল। প্রথম চোটেই বেড়িবাঁধগুলো হয় ভেঙে গেছে; না হয় বানের পানি বাঁধ উপচে রাস্তাঘাটসহ লোকালয় ভাসিয়েছে কিংবা বাঁধ চুঁইয়ে পানি ঢুকে একপর্যায়ে খোদ বাঁধকেই করে দিয়েছে দুর্বল ও ভঙ্গুর। টিভির খবর, বাংলাদেশের ২২৩টি বাঁধ এবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রথমেই ক্ষতির শিকার। এতে প্রধানত বৃহত্তর খুলনার জনবসতির বাড়িঘর ডুবেছে, হাজার হাজার টন মাছের ঘের হয়েছে প্লাবিত আর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠও হয়েছে নিমজ্জিত। তাই টেকসই বাঁধ কিভাবে বানানো যাবে, তা নিয়ে সবার এখন গভীর উদ্বেগ। আসলে টেকসই সুশাসন ছাড়া টেকসই বা যুৎসই বাঁধ তৈরি করা যায় না। তা করা হলেও দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সততা ও দায়িত্ববোধের অভাব মিলে ফি বছর জনগণের নামে তাদের পয়সায় বিপুল খরচ আর দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্নীতিই বাড়বে। কয়েক বছর আগে সুনামগঞ্জে হাওরের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ বলা হয়েছিল ইঁদুরকে। এখন বলা হচ্ছে, ‘সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণে যতটা উৎসাহী, সংরক্ষণে ততটা নয়।’ মনুষ্যরূপী এই অসৎ ‘ইঁদুর’গুলোকে দমাতে না পারলে আসন্ন বর্ষায় বিরাট হাওর ও বিস্তীর্ণ উপকূলে কী বিপদ ঘটে, কে জানে। এ দিকে পত্রিকার শিরোনাম : ইয়াসের ছোট ধাক্কায় বাঁধে বড় ভাঙন।
১৯৮৯ সালের সম্ভবত ২৯ নভেম্বর রাতেও প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছিল বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। এবারের মতো তখনো সুন্দরবন বুক চিতিয়ে সে ঝড়ের তাণ্ডব ঠেকিয়েছিল নিজে বিপন্ন হওয়ার বিরাট ঝুঁকি নিয়েই। তখন কর্মস্থল পত্রিকা অফিসেই আমার মতো অনেককে সারা রাত কাটাতে হয়েছিল। রাত যত বাড়ছিল, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল ঝড়ের বেগ আর ক্ষতি। সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদ আর বৃক্ষসম্পদের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছিল সে সাইক্লোনের আঘাতে। এমনকি সুন্দরবন থেকে বহু দূরের এই রাজধানী নগরীও কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সকালে যখন মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরছিলাম, দেখেছি- ঘূর্ণির প্রচণ্ডতায় ফার্মগেটের মহীরুহতুল্য বিশাল বৃক্ষ গোড়া উপড়ে পড়ে আছে। আর তার গোড়াতে পুকুরের মতো গভীর ও বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের মার্চ থেকে আজো আমাদের বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসজনিত মহামারী কোভিডের শিকার। ২০২০ সালের মে মাসের শেষ দিকে মাহে রমজানের মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে নেমেছিল ‘আমফান’ (অগচঐঅঘ) ঘূর্ণিঝড়। এর সাথে অনিবার্য ছিল প্রবল বর্ষণ আর জোয়ারের উন্মাদনা। এ অবস্থাতেই রোজার ঈদ করতে হয়েছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের লাখ লাখ দুর্গতকে। তাই হাঁটুপানিতেই ঈদের জামাত আদায়ের অভ‚তপূর্ব দৃশ্যও জাতিকে দেখতে হয়েছিল। এবারো প্রায় একই সময়ে সামুদ্রিক ঝড়ের হামলা। পার্থক্য হলো- চান্দ্রবর্ষের হিসাবে পঞ্জিকা গতবারের চেয়ে ১১ দিন এগিয়ে থাকায় এ বছর ঝড় হলো ঈদুল ফিতরের পরে। তবে কোভিড মহামারীর তাণ্ডব থামেনি। বরং ইদানীং তা বেড়ে গেছে। কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুধু ঝড়ের খবর এবং এর ক্ষয়ক্ষতির কথা। এর বিরাট অংশই বিপন্ন বাঁধের সংবাদ। ঘূর্ণির ঝড় পূর্বাভাসমাফিক হানা দিয়েছে প্রধানত ভারতের পূর্বাঞ্চলে ওড়িশা (আগে আমরা বলতাম ‘উড়িষ্যা’) রাজ্য আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলায়। সেই সাথে ঝড়ের আঘাত লেগেছে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সংলগ্ন, বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের তিন জেলায়। তবে উঁচু জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে একেবারে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত, এ দেশের পুরো সমুদ্র উপকূলের জনপদ। ভারতের কলকাতা মহানগরীও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত যদিও পরম করুণাময়ের অপার কৃপায় বাংলাদেশের ঢাকা নগরী অন্তত এবারের মতো ঝড় থেকে রক্ষা পেয়েছে। ভারত সরকার দুই দিন আগেই বিপদ বুঝতে পেরে ওড়িশার ভুবনেশ্বর এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নিয়েছিল। তার পরও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কম হয়নি। সে দেশের দুই রাজ্যে মারা গেছে কয়েকজন এবং লাখখানেক বসতবাটি পড়ে গেছে। ভারতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় এক কোটি বনি আদম। বাংলাদেশেও নানাভাবে প্রাণহানি ঘটেছে কয়েকজনের।
বেশি কথাবার্তা হচ্ছে শত শত কিলোমিটার বাংলাদেশের দীর্ঘ প্রতিরক্ষা বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ ও স্থায়িত্ব নিয়ে। ‘বেড়ায় যদি খেত খেয়ে ফেলে’, সেটি বিষম উদ্বেগের হেতু। উপকূলের এ বাঁধের ব্যাপারেও তা ঘটেছে। বিশেষ করেÑ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, সুনামগঞ্জে ব্যাপকভাবে বাঁধ কেলেঙ্কারির পর মানুষ এখন বেশি দুশ্চিন্তা করছে খোদ বাঁধ বাঁচানো নিয়ে। ব্যয়বহুল হলেও যে বাঁধ নিজেই বাঁচতে পারে না, সে লোকালয় ও ফসল কী করে বাঁচাবে? এ জন্য মানুষ দায়ী করছে অসৎ ঠিকাদার ও লোভী কর্তাদের। বাংলাদেশে এবারের ‘ইয়াস’ ঘূর্ণিঝড় মূল আঘাত না হানলেও এর জের ধরে নানাভাবে ক্ষতির বহর বাড়ছে। যেমন- জোয়ার, জলোচ্ছ্বাস, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও ফসলের ক্ষতি, রাস্তাঘাট, বৃক্ষসম্পদ ও অবকাঠামোর অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের (ঋণ সুবিধাসহ) ঘাটতি, পানিতে ডুবে কিংবা সর্পদংশনে অথবা পানিবাহিত ব্যাধিতে মৃত্যু, অব্যাহত ভাঙন, ফেরিসহ নৌযান চলাচলে বিঘ্ন প্রভৃতি। প্রাণহানিসমেত এ ক্ষতির পরিমাণ আগামী কয়েক দিনে আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রশাসন এমনিতেই ভাইরাসের মহামারী মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে (বিশেষত মহামারী কোভিডের সাম্প্রতিক দ্বিতীয় তরঙ্গ’-এর পর থেকে) তদুপরি, ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’র মতো ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ। তবুও ভাগ্য ভালো, ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপদ এড়ানো গেছে, না হয় কী অবস্থা হতো, আল্লাহই জানেন। বড় দেশ ভারতের লেজে গোবরে দশা দেখেই অনুমান করা যায় তা। আসলে দেশে আগে টেকসই করা দরকার সুশাসন। তা হলে, উপকূলীয় বাঁধসহ সব ক্ষেত্রে কাজ টেকসই হবে এবং জনগণের কষ্টার্জিত অর্থব্যয় তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে। সুশাসনের জন্য শর্ত হলো- আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি ও জনগণের সচেতন সম্পৃক্ততা। তা হলে দুর্নীতি, অনিয়ম, অপচয়, আত্মসাৎ প্রভৃতি হবে নগণ্য। এটি প্রকৃত গণতন্ত্রের সম্ভব যা নেতার চেয়ে নীতি এবং দলের চেয়ে দেশকে বড় করে দেখতে সাহায্য করে। তখন আর অসাধুতা ও স্বজনপ্রীতিসহ কোনো কারণে ‘সিস্টেম’ গড়ে না ওঠা মাথাব্যথার কারণ হয় না। এমন প্রেক্ষাপটেই আইন ও বিধি প্রত্যাশিত গতিতে চলবে; রাষ্ট্রীয় অর্থের সদ্ব্যবহার হবে সুনিশ্চিত এবং সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সজাগ থাকবে।
পূর্ণিমা ও চন্দ্রের ‘রাহু’
পূর্ণিমায় জোছনার ‘হাসি’তে চার দিক ভরে যায়। রবিঠাকুর উল্লসিত হয়ে বলে গেছেন, ‘জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।’ তবে এবার ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও জোয়ারের উচ্ছ্বাস ছিল দেশের লাখ লাখ উপকূলবাসীর জন্য বেশি আতঙ্কের। এর একটি কারণ ছিল পূর্ণিমার যোগ। সাথে যোগ হয়েছিল চন্দ্রগ্রহণ। বিশেষ করে কোনো কোনো সম্প্রদায়ের লোকজনের বিশ্বাস, চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণকালে ‘রাহুর’ গ্রাস ঘটে এবং এই রাহু যখন চাঁদকে ‘খেয়ে ফেলে’, তখন হয় ‘চন্দ্রগ্রহণ’। ‘রাহু’ বলতে একটি বিরাট অপশক্তিকে বোঝায়। এবার ঝড়ের পর পূর্ণিমা আর চন্দ্রগ্রহণ মিলে ভরা কটালের জোয়ারে জলোচ্ছ্বাসের উঁচু ঢেউ যেন সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছে অনেককে। একই সময়ে মহামারীর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ গ্রাস করেছে বাংলাদেশসহ অনেক রাষ্ট্র। স্মর্তব্য, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিবাগত রাতেও পূর্ণিমাজনিত অস্বাভাবিক জোয়ার ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেকের ভীতির কারণ।