বেলারুশে গণতন্ত্র মুছে ফেলার কুশীলব লুকাশেঙ্কা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ আলেকজান্ডার রাইহোরাভিচ লুকাশেঙ্কা। বিবিসি, সিনএনএন, রয়টার্স, আল জাজিরা ও এপি নিউজসহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গত বছর এ নামটি ছিল সবচেয়ে আলোচিত। প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর লিড নিউজে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে এই নামটি।
১৯৯৪ সালের ২০ জুলাই পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। সোভিয়েত পরবর্তী বেলারুশের ইতিহাসে তিনি প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হলেও বেলারুশ থেকে সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্রকে মুছে ফেলার কুশিলব হিসেবে তিনি দেশটির সাধারণ মানুষের কাছে নিন্দিত এক ব্যক্তিত্ব। প্রায় একনায়কতান্ত্রিকভাবে তিনি একটানা পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে বেলারুশের শাসনকার্য পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন সময়ে তার পদত্যাগের দাবিতে দেশটিতে অসংখ্য আন্দোলন হয়েছে, অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। তবুও এ স্বৈরশাসকের হাত থেকে দুই যুগেও মুক্তি মেলেনি বেলারুশের জনগণের।
বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেকে তুলে ধরেছেন। ইদানিং বলা হয়ে থাকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে নতুন করে যেভাবে রাশিয়া আবার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, সেটি সম্ভব হত না যদি না ভ্লাদিমির পুতিন একজন লুকাশেঙ্কোকে কাছে না পেতেন। এ কারণে পুতিন প্রশাসনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এ লুকাশেঙ্কোকে। টানিয়া হেন্ডেল, একজন বেলারুশিয়ান গণমাধ্যমকর্মী। বর্তমানে যিনি লিথুয়ানিয়ার অর্থায়নে নির্মিত গণমাধ্যম ‘গ্রিন বেলারুশ ডট ইনফো’র অধীনে কাজ করছেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ‘কৌচসার্ফিংয়ে’র মাধ্যমে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। বেলারুশের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে লুকাশেঙ্কো আমাদের দেশ শাসনকার্য পরিচালনা করছে। তাই তার ভালো ও খারাপ উভয় দিক সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা নেয়ার সুযোগ হয়েছে’। টানিয়া বলেন, লুকাশেঙ্কোর শাসনের সবচেয়ে ভালো দিকটি হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় আমরা অনেকাংশে গোছালো। অবকাঠামোগত দিক থেকেও আমরা অনেক এগিয়ে। কয়েক বছর আগে আমি মালয়েশিয়ায় যাই। রাজধানী কুয়ালামপুর সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর সেরা রাজধানী শহর হিসেবে দাবি করার যোগ্যতা রাখে। তবে আমি যখন কুয়ালামপুরের বাইরে মালয়েশিয়ার অন্যান্য মফস্বল কিংবা গ্রামাঞ্চলের দিকে যাই আমাকে ভীষণভাবে হতাশ হতে হয়।
রাজধানী কুয়ালামপুরের সঙ্গে মালয়েশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের পার্থক্য রাত-দিন। কিন্তু বেলারুশে আসলে আপনি কখনও এমনটি পাবেন না। যে কোনও নাগরিক সুবিধার দিক থেকে রাজধানী মিনস্কের সঙ্গে বেলারুশের অন্যান্য অঞ্চলের খুব একটা পার্থক্য নেই। টানিয়ার মতে লুকাশেঙ্কোর উন্নয়ন পরিকল্পনা ছিল অনেকটা সুষম যার কারণে বেলারুশে প্রায় সকল শ্রেণির মানুষের মাঝে শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়গুলো সমভাবে বন্টন হয়েছে। টানিয়া বলেন, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আমাদের দেশের শিক্ষার মান ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে উন্নত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক যে কোনও সূচকে অনেক এগিয়ে। শিক্ষাক্ষেত্রে এ দেশে কোনও বৈষম্য নেই এবং একজন শিক্ষার্থী এ দেশে অত্যন্ত কম খরচে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেন। ‘লুকাশেঙ্কো আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন, এ কারণে মাঝারি আয়তনের দেশ হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব ইউরোপের মধ্যে আইটি সেক্টরে আমরা সবচেয়ে এগিয়ে। আমাদের রাজধানী মিনস্ক ইতোমধ্যে পূর্ব ইউরোপের ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।’ বেলারুশকে ইউরোপের অন্যতম পরিচ্ছন্ন দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন টানিয়া। এ প্রসঙ্গে টানিয়া বলেন, ‘আপনি ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইউক্রেন, ইতালি, সার্বিয়া, গ্রিস যেখানে যান না কেনও কোথাও না কোথাও আপনার চোখে অপরিছন্ন রাস্তা-ঘাঁট ধরা পড়বেই। কিন্তু আপনি বেলারুশের কোথাও আপনি এক ফোঁটা ময়লাও খুঁজে পাবেন না। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র লুকাশেঙ্কোর কারণে।’
লুকাশেঙ্কোর আরও একটি পজিটিভ দিক হচ্ছে তিনি একজন ভেগান অর্থাৎ তিনি কোনো ধরনের প্রাণীজ খাবার গ্রহণ করেন না এবং লেদার থেকে শুরু করে সকল ধরনের প্রাণীজ দ্রব্য ব্যবহার থেকেও তিনি বিরত থাকেন।’ এত উন্নয়ন এবং এত ইতিবাচক বিষয়ের পরও কেনও বেলারুশের ইতিহাসে লুকাশেঙ্কো একজন ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব? এ প্রশ্নের উত্তরে টানিয়া বলেন, ‘১৯৯১ সালের ২৫ আগস্ট ইউএসএসআরের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে আমরা পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। তবে গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে আমাদের এ যাতায়াত সুখকর ছিল না। ১৯৯৪ সালে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের দেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে লুকাশেঙ্কো ছিলেন সফলতম মিলিটারি পার্সোনেলদের মধ্যে একজন অথচ তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল রক্ষণশীল কমিউনিজমের ছাপ থেকে অনেক দূরে। আবার পুরোপুরিভাবে তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিও আস্থাশীল ছিলেন না। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ছিল অনেকটা মাঝামাঝি ধরনের, এ কারণে তাকে আমরা বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করি। টানিয়ার মতে লুকাশেঙ্কো জনগণের রায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেও বেলারুশের গণতান্ত্রিক অবকাঠামোকে পুরোপুরি ভূলণ্ঠিত করার পেছনে তিনি দায়ী।
এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চরিত্রের লুকাশেঙ্কোকে আমরা দেখতে পাই। এদেশের সংবিধানকে তিনি সম্পূর্ণ নিজের মর্জিমতো সাজিয়েছেন। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছিলাম, আমাদের সে স্বপ্নকে তিনি পুরোপুরিভাবে ধূলার সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। কার্যতভাবে তিনি আবারও বেলারুশকে রাশিয়ার স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছেন। এ কারণে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক দিক থেকে সেভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। এ দেশের সর্বত্র তাই রাশিয়ার প্রভাব। ইউএসএসআরের মাধ্যমে আমাদের অর্জন কেবলমাত্র একটি পাসপোর্ট, আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তবে সেটা কেবলমাত্র কাগজে-কলমে। বাস্তবে আমরা রাশিয়ার একটি উপ-নিবেশ রাষ্ট্র হিসেবে বসবাস করছি। টানিয়া বলেন, জাতিগতভাবে আমরা বেলারুশিয়ান এবং আমাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু এখনও স্কুল-কলেজে সেভাবে আমাদের ভাষা শেখানো হয় না, স্বাধীনভাবে আমরা আমাদের ভাষা চর্চা করতে পারি না। নিজেদের স্বতন্ত্র মাতৃভাষা থাকার পরেও আমাদের দেশে রুশ ভাষার প্রভাব আমাদের মাতৃভাষার তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রাশিয়া অনেকটা ধ্বংস করে দিয়েছে। লুকাশেঙ্কো এতো কিছু দেখার পরেও কিছু বলেন না কেননা রাশিয়ার সমর্থন ছাড়া তিনি কোনো দিনও আজকের এ পর্যায়ে আসতে পারতেন না। তিনি বলেন, ক্ষমতা চরিতার্থ করতে লুকাশেঙ্কো বেলারুশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের যাবতীয় প্রতিষ্ঠান তার একক করায়ত্ত্বে। এ দেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তিনি তার নিজস্ব সম্পদে পরিণত করেছেন। আমলাতন্ত্র আমাদের দেশের মানুষের এক নিত্যদিনের দুর্ভোগের নাম। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ দুর্নীতি, যদি কেউ তার অপশাসনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেন তাহলে তাকে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়।
সাংবাদিক নির্যাতনের হার এ দেশে অনেক বেশি। লুকাশেঙ্কো আমাদের দেশের মানুষকে মিথ্যা প্রলোভন দেখাতে ভালোবসেন। এদেশের সাধারণ মানুষের আয় মাসে ৮০ থেকে ১৩৩ ইউরো অথচ লুকাশেঙ্কো সব সময় বলেন আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের আয় ৪৫০ ইউরোর ওপরে। ১৯৯৪ সালের পর আয়োজিত কোনও নির্বাচনে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছেন এমনটি এদেশে কেউ দাবি করতে পারবেন না। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লুকাশেঙ্কোর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে চেয়েছিলেন এসভিআটলানা টিখায়োনাভাস্কা, শুধুমাত্র এ একটি কারণে তার ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। টানিয়ার মতে একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যতোই উন্নয়ন করুক না কেনো, যদি সে দেশে সুষ্ঠু জবাবদিহি নিশ্চিত করা না হয় কিংবা যদি সেদেশের জনসাধারণকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া না হয় তাহলে সে দেশে কোনও ধরনের উন্নয়ন ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারে না। টানিয়া স্বপ্ন দেখেন একদিন বেলারুশে লুকাশেঙ্কো যুগের অবসান ঘটবে। যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেলারুশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একদিন সে স্বপ্ন সত্যি বাস্তবে পরিণত হবে। তাই টানিয়ার শেষ উক্তিটি ছিল, ‘এবারের যাত্রায় হয়তো লুকাশেঙ্কো রক্ষা পেয়েছেন কিন্তু একদিন আবারও আমরা জেগে উঠব এবং সেদিন সত্যিই জয় হবে এ দেশের জনগণের।’