সারা শরীরে খুন্তির ছ্যাঁকা, প্লায়ার্স দিয়ে ফুটো করা হয় মাথা

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ মায়ের বান্ধবীর বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে এক বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে শিশু আমেনা খাতুন (১১)। সারা শরীরে গরম খুন্তির ছ্যাঁকার দাগ। ক্ষত শুকিয়ে কালশিটে পড়ে গেছে। বুকের ওপরে উঠে পা দিয়ে পাড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্লায়ার্স দিয়ে ফুটো করে দেয়া হয়েছে মাথা, চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অমানবিক নির্যাতনের শিকার আমেনা এখন যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সে সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের নূর ইসলাম ও আকলিমা খাতুনের মেয়ে। আমেনার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। নানা মারা গেছেন জন্মের আগেই। বয়স যখন সাত বছর, তখন নানি জোহরা খাতুন মা আকলিমাকে আবার বিয়ে দিয়ে দেন। ভিক্ষা করে নানি লালন-পালন করতেন আমেনাকে। আমেনা খাতুনের মা আকলিমা জানান, গত বছর করোনার আগে তার ছোটবেলার বান্ধবী শ্যামলী বৈরাগী আমেনাকে তার সঙ্গে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। শ্যামলীর দুই শিশুসন্তান রয়েছে। ঢাকার বাসায় থেকে আমেনা তাদের দেখাশোনা করবে। আমেনার থাকা-খাওয়া মানুষ করার দায়িত্ব তার। সরল বিশ্বাসে বান্ধবীর হাতে মেয়েকে তুলে দেন আকলিমা।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নির্যাতনের শিকার শিশু আমেনা জানায়, শ্যামলী বৈরাগী তাকে ঢাকার মহাখালীতে সাততলা সরকারি কোয়ার্টারে নিয়ে যান। সেখানে শ্যামলী, তার স্বামী বাদল শিকদার ও শাশুড়ি লিলি থাকেন। শ্যামলীর শাশুড়ি সরকারি হাসপাতালের নার্স। ওই বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর দু’মাস ভালো ছিল আমেনা। এরপর থেকেই শুরু হয় নির্যাতন। বাড়ির কাজের একটু এদিক-ওদিক হলেই তাকে বেধড়ক মারপিট করতেন শ্যামলী ও তার স্বামী বাদল। আমেনা বলে, তাকে দিয়ে বাসাবাড়ির সব কাজ করানো হতো। এর আগে সে কোথাও কাজ করেনি বা শেখেনি। রুটি বানানো দিয়ে তাকে দিয়ে কাজ করানো শুরু হয়। রুটির পরিমাণ কম হলে তাকে মারপিট করা হতো। হাত থেকে পিরিচ পড়ে গেলে, কেন পড়লে জানতে চেয়ে মারধর করা হতো। শিশু আমেনার সারা গায়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা। হাত ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাত মচকে দেয়া হয়েছে। প্ল্যায়ার্স দিয়ে মাথার চুল টেনে টেনে উঠিয়ে দিয়েছেন শ্যামলী ও তার স্বামী। গলায় এবং মাথায় আঘাতের চিহ্ন। আমেনা জানায়, রুটি বানানোর বেলন দিয়ে একবার তার পায়ে এমনভাবে পেটানো হয় যে, বেলন ভেঙে যায়। শ্যামলীর স্বামী বাদল শিকদার তার পায়ে পাড়া দিয়েছেন, শ্যামলী বুকের ওপর দাঁড়িয়ে লাফালাফি করেছেন। মুখে টেপ লাগিয়ে হত্যাচেষ্টাও করেছেন এই দম্পতি। তবে এসব অত্যাচার-নির্যাতনের কিছুই জানতে পারেননি আমেনার মা ও নানি। আকলিমা খাতুন জানান, ফোন করলেই শ্যামলী বৈরাগী বলতেন, আমেনা ভালো আছে। ফোনে লাউড দিয়ে কথা বলাতেন। তারা নির্যাতনের কিছুই জানতে পারেননি।
আমেনার নানি জোহরা খাতুন জানান, একমাস আগে তিনি আমেনাকে দেখতে ঢাকায় যান। কিন্তু বাদল তাকে বাড়ি নেননি। তার কাকা তাকে মীরপুরের বাসায় নিয়ে যান। তাকে বলা হয়, শ্যামলী-বাদল বরিশালে বেড়াতে গেছেন। আমেনাকে তাদের সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যশোরে ফিরে জোহরা খাতুন ফোন করে আমেনার জন্য কান্নাকাটি করেন। একপর্যায়ে এক সপ্তাহ আগে আমেনাকে নিয়ে আসার জন্য তার মা আকলিমাকে ফোন করেন শ্যামলী। এরপর গত ২৩ মে তার নানি ঢাকায় গিয়ে আমেনাকে নিয়ে আসেন। এরপর ২৫ মে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আমেনার মা আকলিমা বলেন, ‘মেয়েটাকে শ্যামলীর কাছে দিয়েছিলাম ভালো থাকবে বলে। কিন্তু তার এই অবস্থা করবে ভাবতেই পারিনি। আমি আমার মেয়ে নির্যাতনের বিচার চাই।’ এ ব্যাপারে বক্তব্য নিতে বাদল শিকদার ও শ্যামলী বৈরাগীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তারা রিসিভ করেননি। হাসপাতালে আমেনাকে চিকিৎসা দেয়া যশোর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অজয় কুমার সরকার জানান, তার শরীরে অসংখ্যা পোড়া বা ছ্যাঁকার দাগ ও নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষত শুকিয়ে গেছে। অনেক দিন ধরেই এই ক্ষতগুলো হয়েছে। তাকে যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
যশোরে ফেরার পর আমেনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তিতে সহযোগিতা করা রক্তদাতা ও সামাজিক সেবামূলক সংগঠন ‘স্বজন সংঘের’ সাধারণ সম্পাদক সাধন কুমার দাস জানান, জোহরা খাতুন প্রথমে আমেনাকে নিয়ে গ্রাম্যডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। এমন নির্যাতনের খবর পেয়ে তিনি ও তার সংগঠনের যুগ্ম-সম্পাদক সঞ্জয় কুমার নন্দী তাদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। মামলা করার জন্য যশোর কোতোয়ালি থানায়ও যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু থানা থেকে ঢাকার সংশ্লিষ্ট থানায় মামলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সাধন কুমার দাস বলেন, আমেনার মা ও নানি অসহায়-দরিদ্র মানুষ। তাদের পক্ষে ঢাকায় গিয়ে মামলা করা সম্ভব নয়। এজন্য তিনি মামলা দায়ের ও নির্যাতনকারীদের শাস্তির জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম বলেন, ‌অভিযোগটি তিনি শুনেছেন। ভুক্তভোগীদের থানায় লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর ডিএমপির সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।