যশোর মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কিশোরকে, পরিচালকসহ আটক ১৪

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর শহরের রেল রোডস্থ যশোর মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকাসক্ত কিশোর মাহফুজুর রহমানকে প্রহারসহ নানাভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই কেন্দ্রের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় তাকে পেটানোর দৃশ্য ধরা পড়েছে। তাছাড়া কেন্দ্রের কর্মকর্তারাও কিশোরকে মারধরের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাদের দাবি, চিকিৎসাধীন অন্য মাদকাসক্তরা তাকে মারপিট করেছিলো।
পুলিশ এ ঘটনায় শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে কেন্দ্রের দুজন পরিচালকসহ ১৪ জনকে আটক করে। গতকাল রোববার তাদের বিরুদ্ধে সন্তান হত্যার অভিযোগ এনে কোতয়ালি থানায় মামলা করেছেন নিহতের পিতা মনিরুজ্জামান। আজ সোমবার আটক আসামিদের আদালতে সোপর্দ করার কথা রয়েছে। নিহত মাহফুজুর রহমান চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের মনিরুজ্জামানের ছেলে। জীবননগর পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তার এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিলো।


নিহত মাহফুজুর রহমানের পিতা মনিরুজ্জামান জানান, তার ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার কারণে গত ২৬ এপ্রিল তাকে যশোর মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। গত শনিবার বিকেলে ওই কেন্দ্রের মাসুম কবীর নামে একজন পরিচালক তাকে ফোন করে জানান, তার ছেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এ জন্য তাকে যশোরে তাদের প্রতিষ্ঠানে আসতে বলেন। এরপর যশোরে উদ্দেশ্যে রওনা হলে তাকে ফের ফোন করে বলা হয়, ‘আপনি মন শক্ত করুন। আপনার ছেলে মারা গেছে।’ পরে যশোরে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে এসে ছেলের লাশ দেখতে পান তিনি। এ সময় তার ছেলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের একাধিক চিহ্নও দেখতে পেয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সহায়তায় চিকিৎসাধীন অন্য মাদকাসক্তরা তার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।


কোতয়ালি থানার ওসি মো. তাজুল ইসলাম জানান, যশোর মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি মাদকাসক্ত কিশোর মাহফুজুর রহমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের কাছে মারপিটের ভিডিও ফুটেজও রয়েছে। তিনি বলেন, ওই কেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক দিয়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করানো হয় না। মূলত চিকিৎসার নামে ভর্তি রোগীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। নিহত মাহফুজুর রহমানকে চড় থাপ্পড়, লাথির পাশাপাশি রুটি বানানোর বেলন দিয়ে পেটানো হয়েছে। বাথরুমে নিয়ে তার চোখে মুখে অন্তত ৫০ বার পানি নিক্ষেপ করা হয়েছে। এভাবে পানি নিক্ষেপ করাটাই না-কি সেখানকার চিকিৎসার ব্যবস্থা। তিনি বলেন, এভাবে নির্যাতনের কারণে কিশোর মাহফুজুর রহমানের মৃত্যু হয়েছে বলে তারা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন। হত্যার পর অসুস্থজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার চালিয়েছিলেন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। এরপর দুপুরে তার লাশ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান কেন্দ্রের লোকজন।
ওসি মো. তাজুল ইসলাম আরো জানান, মাহফুজুর রহমানকে মারপিটের সময় পরিচালক আশরাফুল কবির কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। কেন্দ্রের পরিচালক মাসুম কবীর জানান, ওই কিশোরকে পুলিশি প্রহরায় তার পরিবারের লোকজন তাদের কেন্দ্রে এনে ভর্তি করেছিলেন। সেই সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের কেন্দ্রে চিকিৎসাধাীন অন্য মাদকাসক্তরা মাহফুজুর রহমানকে মারধর করেছিলো। যা পরে তিনি জানতে পেরেছেন।
পুলিশ জানায়, কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, শনিবার ভোর ৫ টা ২০ মিনিটের দিকে একটি কক্ষ থেকে নিজ বিছানা নিয়ে অন্যত্র যাবার চেষ্টাকালে মাহফুজুর রহমানকে বাধা দিচ্ছে কয়েকজন যুবক। বাধা পেয়ে ফের কক্ষের ভেতর বিছানা পেতে বসলে ওই যুবকেরা এসে তাকে ঘিরে ধরে এবং চড়-থাপ্পড় ও লাথি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা তাকে ধরে পাশের বাথরুমে নিয়ে যায়। ওসি মো. তাজুল ইসলাম জানান, কিশোর মাহফুজুর রহমানকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে তারা কেন্দ্রের দুজন পরিচালকসহ ১৪ জনকে আটক করেন। এরা হলেন, পরিচালক আশরাফুজ্জামান তুহিন ও মাসুম কবীর এবং কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য ভর্তি মাদকাসক্ত ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের মৃত সাবদার রহমানের ছেলে শাহিনুর রহমান, নাসির উদ্দিনের ছেলে আরিফুজ্জামান, যশোর শহরের পুরাতন কসবা কাজীপাড়ার কামরুজ্জামানের ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান, নীলগঞ্জ সাহাপাড়ার আব্দুর রশিদ মিয়ার ছেলে রেজাউল করিম রানা, সদর উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে অহিদুল ইসলাম, শহরের বকচর হুশতলার আবুল হোসেনের ছেলে আল শাহরিয়ার রোকন, শার্শা উপজেলার শাখারীপোতা গ্রামের মুকুল হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন, অভয়নগর উপজেলার বুইকরা গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম, যশোর শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক এলাকার এস এম জি মুক্তাদির ছেলে এস এম সাগর আজিম, শহরতলীর শেখহাটির মৃত ফজর আলীর ছেলে নুর ইসলাম, চৌগাছা উপজেলার বিশ্বাসপাড়ার মশিয়ার রহমানের ছেলে রিয়াদ ও সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বামনখালী গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে অহিদুল ইসলাম।
কোতয়ালি থানা পুলিশের ইনসপেক্টর (তদন্ত) তাসমীম আলম জানান, কিশোর মাহফুজুর রহমানকে হত্যার অভিযোগে নিহতের পিতা মনিরুজ্জামান কেন্দ্রের দুজন পরিচালকসহ ১৪ জনকে আসামি করে রোববার থানায় মামলা করেছেন। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে যশোর মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে আসছে। যারা চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন তাদের পরিবারের কাছ থেকে ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। কিন্তু সেখানে চিকিসার জন্য সংশ্লিষ্ট কোনো চিকিৎসক নেই। অথচ যশোরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে যশোরের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মো. বাহাউদ্দিন জানান, ওই কেন্দ্রের অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেখানে একজন কিশোরের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছেন। বিষয়টি তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন।