অবৈধ অনুপ্রবেশে সীমান্তের ২৯ জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সীমান্ত বন্ধ থাকলেও অবৈধভাবে ভারত থেকে মানুষ আসা ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে আসছে। দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ছয়টিই ভারতীয় সীমান্তবর্তী। মোট ২৯টি জেলার ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে মানুষ যাতায়াত করছেই। বৈধ পথে যারা ফিরছেন, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু যারা অবৈধ পথে ফিরছেন, তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে দেশে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে সীমান্তের ২৯ জেলায় সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এভাবে বাড়তে থাকলে সীমান্তবর্তী জেলাসমূহে আইসিইউর সংকট দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, অবৈধভাবে ভারত থেকে মানুষ আসা বন্ধ না হওয়া দেশের জন্য বিপজ্জনক। যে কোনো সময় দেশে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের পূর্ণ সংক্রমণ শুরু হতে পারে। আর সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া কঠিন হবে। মহাদুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে অনতিবিলম্বে সীমান্তে সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেন, ভারত থেকে আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের অনেকের শরীরেই সংক্রমণ ধরা পড়ছে। অধিক সংক্রমণশীল ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের রোগীও পাঁচ জন শনাক্ত হয়েছেন। তাই সীমান্তে এখনই কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।
সম্প্রতি সাতক্ষীরায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা ভারতফেরত ১৩৯ জন পাসপোর্টধারী যাত্রীর মধ্যে ১১ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। ভারতে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি একজন ভারতীয় নাগরিক অবৈধ পথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তার শ্বশুরবাড়ি বেনাপোলে। পুলিশ তাকে আটক করে বেনাপোলের একটি হোটেলে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছে। জানা গেছে, বৈধ স্থলবন্দর ছাড়াও দুই দেশের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এর সব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নেই। এখনো অনেক এলাকা আছে, যেখানে একটি বাড়ির ভেতর দিয়ে সীমান্তরেখা গেছে। এসব পথ দিয়ে অবৈধভাবে দৈনিক বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশে প্রবেশ করে। সম্প্রতি যশোরের একটি স্থলবন্দর দিয়ে বৈধভাবে এক দিনে চার জন দেশে প্রবেশ করেছেন। একই দিন ঐ এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করে ৩০ জন। এদিকে বিদেশ থেকে যারা দেশে আসছেন, তাদের বাধ্যতামূলক ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। কিন্তু বৈধভাবে যারা ভারত থেকে আসছেন, তাদের মধ্যে যারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আত্মীয়স্বজন, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা বড় বড় কথা বলেন, নীতি-আদর্শের কথা বলেন, তারাই নিয়ম মানেন না। ভারত থেকে অবাধে মানুষ আসার পাশাপাশি ঈদ-পরবর্তী ফিরতি যাত্রায়ও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। ১০ থেকে ১২ বার গাড়ি বদল করে ঢাকায় ফিরছেন অনেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। অবৈধভাবে ভারত থেকে মানুষ আসা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ।’ সীমান্ত বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে মানুষ আসা বন্ধ না হলে সামনে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে অবৈধ যাতায়াত কখনোই আমরা ঠেকাতে পারিনি। কীভাবে ঠেকানো যাবে জানি না। ভারত থেকে অবৈধভাবে আসছে মানুষ। আইসোলেশনে পুলিশের পাহারায় থাকা নারীও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।’এমন অবস্থায় সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, নিজের জীবন নিজেকে বাঁচাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এবারের ঈদযাত্রা ও সীমান্ত দিয়ে যেভাবে মানুষ আসছে, তাতে করোনার লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে। সামনে মহাদুর্যোগ হতে পারে। ভারতে করোনার ভয়াবহ অবস্থা। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়লে কী অবস্থা হবে তা কল্পনা করা কঠিন। সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, এত বড় সীমান্ত সুরক্ষা দেওয়া কঠিন। তাই সামনে টিকা উত্পাদন ও সংগ্রহে জোর দিতে হবে। ব্যাপক হারে টিকা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। দেশের ৫ থেকে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. রাশেদা সুলতানা বলেন, এ পর্যন্ত কত জন ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন, তার সংখ্যা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে সীমান্তে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যা যা করার প্রয়োজন তা করা হয়েছে। করোনা চিকিত্সার ব্যবস্থাপনাও ভালো।
অভিযোগ উঠেছে, ভারত থেকে আসা ট্রাকের সঙ্গে ড্রাইভার ও সহকারীরা বিপজ্জনক ভারতীয় ধরনের করোনার ভাইরাস বহন করে আনতে পারেন। এতে দেশের করোনা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ভারতীয় ড্রাইভার-হেলপাররা স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বেনাপোল বন্দরে যত্রতত্র চলাফেরা করছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক আব্দুল জলিল বলেন, সরকারের গাইডলাইন মেনে তারা স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করছেন। এদিকে গত ৭ থেকে ১৭ মে পর্যন্ত ভারতফেরত পাঁচ জন বাংলাদেশির শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম সেন্টারে স্পাইক প্রোটিনের সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা হয়। জানানো হয়, বি ১.৬১৭.২ নামের ধরনটি জিনোম সেন্টারে শনাক্ত করা হয়েছে। এসংক্রান্ত ফলাফল জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বরাবরই প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ এ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে গণমাধ্যমকে বলে আসছে। গতকালও (বৃহস্পতিবার) সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভারতীয় ধরন চিহ্নিত হওয়ার কোনো তথ্য আমার জানা নেই। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা আইইডিসিআর বলতে পারবে।’