ঈদে বাড়ি ফিরতে বেপরোয়া

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঈদে বাড়ি ফিরতে বেপরোয়া মানুষ। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে বাড়ি ফেরা মানুষের স্রোত ঠেকানো যাচ্ছে না। ঘরমুখো মানুষের চাপ সামলাতে না পেরে গতকাল বিকালে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে। একইভাবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটেও বিকালে সব ফেরি চলাচল করেছে। ফলে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের বিড়ম্বনা কমেছে। এদিকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকলেও মানুষের ঈদযাত্রা থেমে নেই। গাবতলী টার্মিনালের ভিতরে এবার সুনসান থাকলেও আমিনবাজার সেতুতেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেতুর হাঁটাপথ ধরে হাজারো মানুষের স্রোত; তারা ব্যাগ- বোঁচকা টেনে নিয়ে পায়ে হেঁটে চলছেন আমিনবাজার সেতুর ওপারে। ওখানে রাস্তার দুই পাশে যাত্রীর অপেক্ষায় বাস ও লেগুনা। ঈদ সামনে রেখে গত কয়েক দিন ধরেই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। এ কারণে গতকালও উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার টাঙ্গাইলের ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। এ ছাড়া ঘরমুখো মানুষ প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও পণ্য পরিবহনের গাড়িতে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
ফেরি চলাচল স্বাভাবিক : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিসি) বাংলাবাজার ঘাট ম্যানেজার সালাউদ্দিন বলেন,এখন থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক। ঘাটে আটকে পড়া কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করে দিয়েছে। এখন সব ধরনের ফেরি চলাচল করবে। তাই ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের আর বিড়ম্বনা পোহাতে হবে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ঘাটে ফেরি চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন ঈদ সামনে রেখে ঘরমুখো মানুষ। শুধু লাশ ও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স এবং জরুরি কাজে ব্যবহৃত পরিবহনের ফেরি পারাপারে অনুমতি দেওয়া হয়। তারপরও ঘাটে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অনেককে ফেরিতে উঠতে দেখা গেছে। এদিকে ঘাটে অতিরিক্ত যাত্রীদের চাপে ফেরিগুলোতে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি গাড়ি পারাপারে বিলম্ব হয়। ঘাটে আটকে থাকা বিভিন্ন ধরনের পচনশীল পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছিল।
গাবতলী সুনসান, হাঁকডাক আমিনবাজারে : রাজধানী থেকে ঈদযাত্রা মানেই গাবতলী টার্মিনালে উপচে পড়া ভিড়, আর হাজারো মানুষের অপেক্ষা। তবে এবারের চিত্রটা একেবারেই উল্টো। গতকাল দুপুরে গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল সারি সারি কাউন্টারগেুলো সব বন্ধ। সুনসান টার্মিনালের ভিতরে বাসগুলোও পড়ে আছে, কারও কোথায় যাওয়ার তাড়া নেই। কর্মীরা বেঞ্চে বসে মোবাইলে লুডু খেলছেন। তবে টার্মিনাল ছেড়ে সামনে আমিনবাজার সেতুতেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। সেতুর হাঁটাপথ ধরে হাজারো মানুষের স্রোত; তারা ব্যাগ-বোঁচকা টেনে নিয়ে চলছেন পায়ে হেঁটেই। সেতু পেরোতেই শোনা গেল চিরচেনা সেই হাঁকডাক। ‘ঘাট তিনশ, পাটুরিয়া তিনশ’ বলে সুর করে ডেকে চলেছেন কয়েকটি বাস ও লেগুনার সহকারীরা। আমিনবাজার সেতুর ঢাকাপ্রান্তে নিয়ম মানার যে কড়াকড়ি ছিল, সেতু পার হতে না হতেই যেন সব ঢিলেঢালা। গাবতলীর দিকে পুলিশের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেতু পার হতেই একজনকেও দেখা গেল না। সেতুর ওপরই তিন টনের ট্রাক থামিয়ে যাত্রী তুলছিলেন চালক ও সহকারী। যাবেন কোথায় জিজ্ঞেস করতেই সহকারী এগিয়ে এসে বললেন, ‘ঘাট একদাম দুইশ। আমার চাইতে কম আর পাইবেন না।’ রাস্তার দুই পাশে রাজধানীতে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের কয়েকটি বাস রাখা। সহকারীদের বেশিক্ষণ ডাকাডাকি করা লাগছে না। কয়েক মিনিটেই বাসগুলো ভরে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন পথে চলাচলকারী এসব বাসই এখন ঘরমুখো মানুষের বাহন হয়ে উঠেছে। গাবতলী হয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাওয়া যায়। ঘরমুখো মানুষ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এখন যে জনস্রোত তাদের বেশির ভাগের গন্তব্য কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। পরিবহন কর্মীরা জানালেন, উত্তরাঞ্চলের বাসগুলো ছেড়ে যাবে সন্ধ্যার পর বাইপাইল ও চন্দ্রা এলাকা থেকে। তখন আবার এই যানবাহনগুলো বাইপাইল ও চন্দ্রার দিকে চলাচল করবে।
শিমুলিয়ায় মানুষের ঢল : দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রেখেও থামানো যাচ্ছে না নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল। মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে গতকালও স্বাস্থ্যবিধি ছিল উপেক্ষিত। গত কয়েক দিনের মতো গতকালও সকাল থেকেও করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। যে যেভাবে পারছে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার লক্ষ্যে ভিড় জমাচ্ছে ঘাট এলাকায়। ভোর থেকে ঘাটে পারাপারের লক্ষ্যে মানুষের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ঘাট এলাকায় এ সময় যাত্রীর ঢল ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ঘাট কর্তৃপক্ষকে। গেল শুক্রবার থেকে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপ বাড়ে এই ফেরিঘাটে। ফেরিঘাট এলাকায় মানুষের এমন ঢল নামার কারণে শনিবার বিকালেই শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় পুলিশের পাশাপাশি দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। বিজিবি সদস্যরা ফেরিঘাটের প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে টহল চৌকি বসিয়ে কোনো প্রকার যাত্রী বহন করা যানবাহন ঘাট এলাকায় প্রবেশ করতে না দিলেও মানুষ পায়ে হেঁটে এবং নানা পথ পাড়ি দিয়ে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ভিড় করছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে এ বছর সরকারি বিধিনিষেধ থাকলেও তা না মেনে বিজিবির টহলকে ছাপিয়ে ঘরমুখো মানুষ ছুটছে ঘাটমুখে। এ ছাড়া যাত্রীরা বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে ট্রলারে চড়ে পার হওয়ার টেষ্টা করলে টহল পুলিশ তাদের আটকে দেয়। এ ধরনের মাছ ধরার ১৩টি ট্রলার সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জব্দ করে নৌপুলিশ এবং ১১ জন মাঝিকে আটক করতে সক্ষম হয়। এদিকে ঘাট এলাকায় কাঁচা পণ্যের ট্রাক অধিক হারে আটকে পড়ায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নৌরুটে চলাচল স্বাভাবিক থাকবে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিসি। গতকাল বিকাল থেকে সব ফেরি চলাচল স্বাভাবিক বলে নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ। জানা গেছে, নৌরুটে মোট ১৬টি ফেরি রয়েছে। এর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ফেরি চলাচল সীমিত করা হয়েছিল। তবে জরুরি যানবাহনের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক যাত্রী নিয়মিত পার হয়ে আসছে। এদিকে ফেরি কমসংখ্যক চলাচল করায় ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। যাতে বেশির ভাগই পচনশীল পণ্য। তাই গতকাল বিকাল থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করা হয়েছে।
পাটুরিয়ায় মানুষের অতিরিক্ত চাপ : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাতায়াতের অন্যতম পথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথ। এ ঘাট দিয়ে ২১টি জেলার মানুষ পারাপার হয়ে থাকে। গতকাল ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে পাটুরিয়া- দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে। অন্যান্য দিনের চাইতে যানবাহন ও যাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে অনেক। ফেরিতে যানবাহনের তুলনায় লোকজন পার হচ্ছে বেশি। ফেরি চলে যাবার পর ঘাট একেবারে যাত্রী শূন্য হয়ে যায়। আবার বিভিন্ন দিক থেকে জড়ো হয় লোকজন। তবে বিকালে যাত্রীর চাপে সব ফেরি চলাচল করে। এ ছাড়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দেখা যায় লোকজন মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন বাহনে পাটুরিয়া ঘাটে আসছেন। তাদের বিশ্বাস ঘাটে পৌঁছাতে পারলেই কোনো না কোনোভাবে নদী পার হওয়া যাবে। একটি ফেরি নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গেই হুমড়ি খেয়ে লোকজন ফেরিতে উঠে পড়ছে। লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে তারাও পার হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ যাত্রীর মুখে মাস্ক থাকলেও দূরত্বের বালাই একেবারেই নেই। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে নদী পার হচ্ছে। ঘাট এলাকায় সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ঈদে ঘরমুখো মানুষের নির্বিগ্নে পারাপারে জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও তিন প্লাটুন বিজিবির টিম বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করছে।
এদিকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সব বাধা পেরিয়ে দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আসছে মানুষ। সব বাধা পেরিয়ে ভোগান্তি নিয়ে ফেরিঘাটে পৌঁছালেও ভোগান্তি নিয়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে মানুষ। দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, মাহেন্দ্র, মোটরবাইক অথবা ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছেন তারা। চট্টগ্রামে ঝুঁকি নিয়েই বাড়ি ফেরা : করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমছেই না। তবুও চরম ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়ি। ফলে বাড়ি যাত্রা করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নগরের অভ্যন্তরের বাসগুলো কম যাত্রী নিয়ে চলাচল করলেও নগর থেকে ছেড়ে যাওয়া পরিবহনগুলোতে গাদাগাদি করে নেওয়া হচ্ছে যাত্রী। গতকাল দুপুরে নতুন ব্রিজ এলাকায় দেখা যায়, অনেক মানুষ বাড়ি যেতে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। যাত্রীর তুলনায় যানবাহন কম হওয়ায় হুড়োহুড়ি করছে সবাই। বাসে নেওয়া হচ্ছে সিটের অতিরিক্ত যাত্রী। নগরে প্রবেশের অপর পথ- সিটি গেট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও অক্সিজেন মোড়ে গণপরিবহনগুলোতে অভিন্ন চিত্র লক্ষণীয়।
সিরাজগঞ্জে মহাসড়কে চাপ আছে, যানজট নেই : ঈদ উপলক্ষে মাইক্রোবাসে করে বাড়ি ফিরছেন অনেকে। অন্য বছরগুলোর মতো এবারও ঘরমুখো হাজারো মানুষ বেশি ভাড়ায় গন্তব্যে ছুটছেন। ঘরমুখো মানুষের একটি বড় অংশ মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানেও যাচ্ছেন। সিরাজগঞ্জ-বগুড়া-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহনের চাপ থাকলেও যানজট দেখা যায়নি। জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ-বগুড়া-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ৩১ হাজার ৮০২টি যানবাহন চলাচল করেছে।